রৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৌদ্ররৃষ্টিরৌদ্ররৃষ্টি রৌদ্রবৃষ্টি রৌদ্রবৃষ্টি রোদ্রবৃষ্টি
   
 
  মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি,

মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি, ষ্টাডি

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

মুষ্টিচাল সমিতির পুরো নাম, ‘মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালি’। নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ থানার একলাশপুর ইউনিয়নের একলাশপুর গ্রামে কিছু গৃহবধুর নিজস্ব জ্ঞান বুদ্ধিতে গড়ে ওঠা এই সমিতি তাঁদের  ঐকান্তিক ইচ্ছার ফসল । নানান প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই নারীরা নীরবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন। এই সমিতি থেকে আমাদের মূল শিক্ষণীয় হল, গ্রাম-বাংলার জনসমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিজস্ব জ্ঞান ও প্রথাকে সহায়ক পরিবেশের মাধ্যমে পরিচর্যা করলে নারীরা নিজেরাই বিকশিত হতে পারেন, এসব জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে অতি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমেও তাঁরা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, চেষ্টা নিয়ে থাকেন।

স্টাডিটি যেভাবে করা হয়েছে
মুষ্টিচাল সমিতি নিয়ে প্রথমে প্রকল্পের জন্য প্রতিবেদন করেছিলাম। এরপর স্টাডিটি করতে যেয়ে সমিতির সদস্যদের সাথে নিবিড়ভাবে কথা বলতে গেলে মনে হয় যে এ কাজটি মেয়েদের দিয়েই ভালো হবে, মেয়ে তথ্য সংগ্রাহকের কাছে সমিতির সদস্যরা মন খুলে কথা বলবেন। তাই পূর্ব যোগাযোগের সূত্রে মাস লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি)-এর পাঁচজন তৃণমূল নারী সংবাদকর্মীর সাথে কথা বলি, তাঁরা কাজটিতে বেশ আগ্রহ বোধ করেন এবং স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে রাজী হন। ২২ অক্টোবর ২০০৩ এই দলটি একলাশপুর গ্রামে গিয়ে স্টাডিটি শুরু করেন। পাঁচজন সংবাদকর্মী পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রথমে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির সদস্যদের সাথে পৃথক পৃথকভাবে আলাপ করেন এবং মূলত অংশগ্রহণমূলক  আলোচনার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করেন। 

এরপর সংবাদকর্মীরা এলাকার অন্যান্য মানুষদের সাথে আলোচনা করে এলাকা সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা নেন। এরপর প্রতিটি সংবাদকর্মীর সংগৃহীত তথ্য এক জায়গায় এনে প্রাথমিক রিপোর্টটি তৈরি করা হয়।

স্টাডিটির পরবর্তী পর্যায়ের জন্য এই দলেরই দুজন স্বেচ্ছাসেবী সংবাদকর্মীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে স্টাডিটি কীভাবে করা যায় সে ব্যাপারে  গবেষণা তত্ত্বাবধানকারী তাঁদের সাথে আলাপ করেন। পুরো স্টাডিটি শেষ করতে তিন মাস সময় লেগেছে।

স্বেচ্ছাসেবী সংবাদকর্মীরা হলেন: ১. খালেদা আক্তার লাবনী ২. সাজিয়া ফেরদৌস পান্না ৩. শাহনেওয়াজ সারওয়ার দিনা ৪. নাজনীন সুলতানা এবং ৫. আয়শা আক্তার হেলেন।

এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলো মূলত অক্টোবর ২০০৩ থেকে জানুয়ারি ২০০৪ সময়কালে সংগৃহিত হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এপ্রিল ২০০৫-এ প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার সময় নাগাদ পরিবর্তনের কথা সংযোজিত হয়েছে। এই সংযোজন/সংশোধন গুলোর সাথে সেটা উল্লেখ করা আছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক সমন্বয়কারী যাচাইপর্বে , যে পর্যবেক্ষণ গুলো করেছেন তা মূল প্রতিবেদনে সন্নিবেশিত হয়েছে আবার আলাদা সংযোজনী হিসেবেও রাখা হয়েছে। 
 
গবেষণার সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
নোয়াখালী একটি ঘনবসতি জেলা। সমগ্র জেলাটি একটি কৃষিপ্রধান এলাকা। এর প্রধান অর্থকরী ফসল ধান। জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষক, এর মধ্যে বিত্তহীন, অত্যন্ত দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বেশি। কৃষিকাজ ছাড়াও অনেকে অন্যান্য নানান কাজ করে থাকেন। গ্রামাঞ্চলের মানুষের একটি বড় অংশ দিনমজুরির ওপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

একলাশপুর গ্রামটি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার ১৭ নং একলাশপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। একলাশপুর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের একটি একলাশপুর গ্রাম। মুষ্টিচাল সমিতি গড়ে উঠেছে একলাশপুর গ্রামের দালানবাড়ি এলাকায়, যা একলাশপুর গ্রামের পূর্ব অঞ্চলের অন্তর্গত এবং জেলা শহর মাইজদির খুব কাছে। এই এলাকার বিভিন্ন জন আলাপ-আলোচনায় মূলত আনুমানিক হিসাব করেই বলেছেন যে দালানবাড়ি এলাকায় আনুমানিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ বসবাস করছেন (২০০৩ সালের শেষের দিকে)।

ব্রিটিশ আমলে এখানে নির্মিত হয় সরলাদেবী বালিকা বিদ্যালয়, এর বিদ্যালয় ভবনটি ছিল পূর্ব একলাশপুর এলাকার মধ্যে ইটের তৈরি একমাত্র পাকা দালান। স্কুলটি প্রথমে জুনিয়র স্কুল হলেও পরে এটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয় এবং নাম পাল্টে পূর্ব একলাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রাখা হয়, স্কুলটির বর্তমান নাম এটাই। ভবনটিকে ধরে গ্রামের মানুষ এলাকার পরিচয় দিতেন, সেই থেকে এলাকার নাম দালানবাড়ি। এ গ্রামের পূর্ব পাশ ঘেঁষে চলে গেছে নোয়াখালি-লাকসাম রেললাইন। এই রেললাইনের দুই কিলোমিটার দেিণ মাইজদি রেলষ্টেশন এবং সাত কিলোমিটার উত্তরে চৌমুহনী রেলষ্টেশন। চৌমুহনী বাজারটি নোয়াখালির বৃহত্তম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সরিষার তেলের ঘানির জন্য এ বাজারটি পুরো দেশে প্রসিদ্ধ। দালানবাড়ি থেকে নোয়াখালির মূল শহর মাইজদি কোর্ট প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে।

নোয়াখালির গ্রামীণ জনপদে ধর্মীয় প্রভাব ব্যাপক। সমাজে যুগ যুগ ধরে নানা সংস্কারের প্রচলন। গ্রামাঞ্চলে পর্দার প্রচলন এখনো ব্যাপক। গ্রামীণ নারীরা সহজে ঘরের বাইরের কাজে যান না। দুএকজন শিক্ষিত নারী এ প্রথার বাইরে আসার চেষ্টা করলেও এর ব্যাপক কোনো আবেদন সৃষ্টি হয়নি। এ গ্রামে সরকারি-বেসরকারি কোনো উন্নয়ন কাজ বেশি আকারে হয়নি। এলাকার পাশেই আছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যার কথা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, আর আছে একটি সরকারি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এটি স্থাপিত হয়েছে আশির দশকের শেষ দিকে। গত কয়েক বছর ধরে সেখানে ডাক্তার নিয়মিত বসেন না, যদিও নিয়মিত ডাক্তার থাকার কথা। এলাকাবাসী অনেকে জানান কেন্দ্রটিতে ডাক্তার সকাল এগারটার দিকে এসে দুপুর দেড়টা-দুটোর দিকে চলে যান। একলাশপুর হাইস্কুল দালানবাড়ি থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে যেখানে গ্রামের প্রাইমারি-পরবর্তী ছেলেমেয়েরা যায়। এছাড়া ঐ হাইস্কুলের পাশেই আছে মাদ্রাসা, গ্রামের কিছু পড়ুয়া সেখানেও যায়।

একলাশপুর গ্রামে অধিকাংশ ব্যক্তির পেশা কৃষি, তবে অনেকেই বিভিন্ন কলকারখানাতেও কাজ করেন। একলাশপুর গ্রাম এবং এর আশেপাশের এলাকার জমিগুলো মূলত এক ফসলী। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক পর্যন্ত জমি সাধারণত পানির তলায় থাকে, ফসল হয় না, ফলে ঐ সময়টা কৃষিমজুরির কাজ খুব একটা থাকে না। বছরের একটা বড় সময় কাজ না থাকায় নোয়াখালীর অন্যান্য এলাকার মতোই দালানবাড়ি এলাকার অধিবাসীদের একটি ব্যাপক অংশ অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় দিন কাটান। এলাকায় পুরুষ শ্রমিকের দিনে মজুরি গড়ে ১০০ টাকা, ব্যস্ত সময়ে যখন মজুর পাওয়া যায় না তখন মজুরি আরো খানিকটা বেড়ে যায়। ২০০৫-এর ফসল কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে একজন পুরুষ শ্রমিক সূর্য ওঠা থেকে মাগরিবের আজান পর্যন্ত কাজ করার জন্য ১২০ টাকা বা এর কিছু ওপরও পেয়ে থাকেন, এর সাথে থাকে তিন বেলা ভাত ও চা-নাস্তা। মাটি কাটার জন্য মৌসুমে পুরুষ শ্রমিক ১৫০ টাকা পেয়ে থাকেন।

দালানবাড়ি এলাকার নারীরা মূলত: গৃহিনী। এখানে মেয়েরা দেশের অন্যান্য অনেক এলাকার মেয়েরা যেভাবে মজুরি শ্রমিক হিসাবে ক্ষেতে খামারে বা অন্যান্য পেশায় কাজ করেন তেমনভাবে কাজ করেন না। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা সাধারণত অন্যের বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটেন যার বিনিময়ে কোনো নির্দিষ্ট হারে আর্থিক মজুরি পান না। তাঁরা তিনবেলা খাবার এবং চাল পেয়ে থাকেন। চালের পরিমাণ নির্ভর করে কাজের ধরনের ওপর এবং গৃহস্থ কতটা অবস্থাপন্ন তার ওপর। একলাশপুর গ্রামের উত্তর দিকে একলাশপুর বাজার থেকে এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে গ্লোব বিস্কুট ফ্যাক্টরি এবং গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ কারখানা যেখানে গ্রামের নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। এলাকার অধিবাসী সাংবাদিক মহিউদ্দিন নসু জানান ইউনিয়ন উইমেন ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান ,  গ্রামের বেশ কিছু মহিলাকে বাঁশ-বেতের সরঞ্জাম ও অন্যান্য হাতের কাজে প্রশিণ দিয়েছিল। এখন সেইসব মহিলাদের মধ্যে কয়েকজন মোড়া, চালুনি, ডালা ইত্যাদি তৈরি করেন যা বাড়িতে এসে ক্রেতারা কিনে নিয়ে যান। এছাড়া কাছাকাছি হোটেলেও শ্রমিক হিসাবে কিছু নারী কাজ করে থাকেন।
এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, কোডেক ইত্যাদি স্থানীয় ও জাতীয় এনজিওগুলো কাজ করছে। একলাশপুর গ্রামটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে।

দারিদ্র্য ও নিদারুণ পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যেই এখানে নারীরা সংসারে নিজস্ব সৃজনশীলতা যোগ করতে সচেষ্ট, তাঁদের সেই চেষ্টা দিয়ে সংসারকে টিকিয়ে রাখেন, সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। এই চিত্র হয়তো দেশের অন্যান্য এলাকায় বাঙালি সমাজের সর্বত্র কমবেশি একই রকম।

গ্রামীণ সমাজে নারীদের এই সৃজনশীলতার একটি দৃষ্টান্ত প্রতিবেলার রান্নার চাল থেকে এক মুঠো তুলে রাখা, ঘরে চাল যখন বাড়ন্ত, স্বামী যখন খাবারের যোগান দিতে পারছেন না, গৃহিনী তখন দুর্দিনের সেই সম্বল বের করেন স্বজন-সন্তানের মুখে আহার তুলে দিতে। মুষ্টিচাল, নোয়াখালিতে যার নাম ‘মুঠ-চাইলা,’ বাঙালি নারীর ঐতিহ্যবাহী প্রথা। শত শত বছরের এই প্রথাকে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে দালানবাড়ির কিছু নারী স্বাবলম্বী হতে চেয়েছেন। মুষ্টিচাল জমিয়ে সেটা বিক্রি করে তাঁরা সপ্তাহে সপ্তাহে সমিতিতে সঞ্চয় জমা দিয়ে পুঁজি তৈরি করতে চেয়েছেন। তাঁদের এই চেষ্টাকে অনুসরণ করতেই এই স্টাডি।

যে জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে মুষ্টিচাল সমিতির কাছে যাওয়া

স্টাডিটি করতে গিয়ে যে মূল জিজ্ঞাসা বা কৌতূহলগুলো নিয়ে আমরা মুষ্টিচাল সমিতির কাছে গিয়েছিলাম, সেগুলো এরকম:
* দালানবাড়ি গ্রামের নারীরা কোন্ আর্থ-সামাজিক পোপটে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি গড়েছেন অর্থাৎ সমিতিতে কোন্ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর নারীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন।
*  সমিতির সদস্যদের পারিবারিক আয় ও সম্পদের পরিমাণ কেমন
* সমিতির সদস্যরা অন্য কোনো আয়মূলক কাজ করেন কি না
* সমিতিটি করতে গিয়ে তাঁরা কী ধরনের ভাবনা, জ্ঞান ইত্যাদি কাজে লাগিয়েছেন
* সমিতির সব সদস্য এর কার্যক্রমে সমানভাবে অংশ নিতে পারেন কি না
* সমিতিতে আগে ছিলেন এখন নেই এমন সদস্যরা কেন চলে গেছেন  
* সমিতিতে জমানো টাকা দিয়ে সদস্যরা কী করেন 
* সমিতির সদস্যরা টাকা-পয়সার হিসাব কীভাবে রাখেন, কখনো টাকা-পয়সা নিয়ে বড় ধরনের কোনো গণ্ডগোল হয়েছে কি না 
*  মুষ্টিচাল জমানোর মতো ধীর লয়ের কাজে এবং স্বল্প পুঁজি থেকে তাঁরা কতটুকু অর্জন করতে পারবেন বলে ভাবছেন 
* সমিতি নিয়ে এর সদস্যরা কী কী চিন্তাভাবনা করছেন।
* সমিতিকে এগিয়ে নেয়ার েেত্র সদস্যদের পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা কী 
* সমিতিটির সরকারি নিবন্ধন হয়েছে কি না
* সমিতির সদস্যরা পরিবারে কতটুকু মূল্যায়িত হন এবং পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা মতামত কতখানি দিতে পারেন 
* সমিতির সদস্যরা সন্তানদের পড়ালেখা করান কি না বা এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন
* সমিতির সদস্যরা স্বাস্থ্য ও সেনিটেশন বিষয়ে কতখানি সচেতন, স্যানিটারি ল্যাট্রিন বা অন্য কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করেন কি না
* সমিতিটি করতে গিয়ে এর সদস্যরা পারিবারিক বা সামাজিক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন কি না, হলে তা কী ধরনের বাধা ছিল, কীভাবে বাধাগুলো পেরিয়েছিলেন
* সমিতি কোনো ধরনের রাজনৈতিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কি না
* সমাজের অন্যরা বিষয়টি কীভাবে দেখেছেন 
* দালানবাড়ি বা এর আশেপাশে মহিলারা বা (পুরুষ) মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন কি না, কেউ এ ধরনের কাজ শুরু করেছেন কি না

মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির উদ্যোক্তা শাহানা কবিরের কথা :

মুষ্টিচাল সমিতির আদি উদ্যোক্তা শাহানা কবির। তিনি একলাশপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মকবুল আহমেদের ভাতিজি। আত্মনির্ভর হওয়ার স্বপ্নটি শাহানা কবিরের মনে কোনো তাত্ত্বিক ধারণা থেকে আসেনি। নিজের জীবনের কঠোর  বাস্তবতা থেকে তিনি উপলদ্ধি  করেছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ শাহানা কবিরকে বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই সংসারের পুরো দায়িত্ব নিতে হয়।  তিনি চাকরি নেন মর্নিং সান কেজি স্কুল নামে একটি ছোট বিদ্যালয়ে। চাকরি নিলেও তাঁর স্বামীর পরিবার মূলত কৃষক পরিবার, সংসারের মূল আয়টি আসে সেখান থেকেই, শাহানাকে সেখানেও দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তাঁর এক মেয়ে ও এক ছেলে। (২০০৫ সালে মেয়েটি মাস্টার্স দিচ্ছেন ও ছেলেটি দশম শ্রেণীর ছাত্র।)

শাহানার নিজের কথায়, ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। আমাদের এখানকার প্রায় প্রতিটি নারী স্বামীর সংসারের উপর এত বেশি নির্ভরশীল যে স্বামী ছাড়া ওদের আর কোনো আশ্রয় নেই। হঠাৎ করে সেই স্বামী যদি মারা যান কিংবা যদি তাঁর কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, অথবা স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান তখন ওদের মানুষের করুণা ভিক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমি সব সব সময় ভাবতাম আত্মনির্ভর হবো।’

আত্মনির্ভর হওয়ার চিন্তা থেকেই তিনি স্থানীয় যুববন্ধন বহুমুখী সমবায় সমিতিতে যোগ দেন। শাহানা জানান এটি কোনো সংস্থার সাথে যুক্ত সমিতি না, এলাকার তরুণরা মিলে এই স্বনির্ভর সমিতিটি গড়ে তুলেছেন। এখান থেকেই তিনি ২০০০ সালের জুলাই মাসে এনজিও হাংগার প্রজেক্টের উজ্জীবক প্রশিণে অংশ নেন। নাঈমুজ্জামান মুক্তা, হাংগার প্রজেক্টের প্রাক্তন কর্মী যিনি উজ্জীবক প্রশিণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, বলেন, “উজ্জীবক এমন একদল অনুপ্রাণিত ব্যক্তি যাঁরা আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে নিজের পাশাপাশি অন্যকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেন। উজ্জীবক প্রশিণ দেয়ার একটি মূল উদ্দেশ্য, প্রশিণের পর যাতে তাঁরা নিজের এলাকায় ফিরে গিয়ে নিজের সৃজনশীলতা, মেধা, দতা কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীলভাবে নিজের উন্নয়ন করতে পারেন এবং সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন।”

শাহানার কথায়: “হাংগার প্রজেক্টে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমার মনের মধ্যে শক্তি আসলো। আমি এবার ভাবতে থাকলাম আমার এলাকার মহিলাদের নিয়ে কিছু করা যায় কিনা। ভাবতে ভাবতেই আমার মাথায় এলো মুষ্টিচাল নিয়ে কিছু করার কথা। প্রথমে আমার ঘরের চারপাশে যারা মহিলা আছে তাদের সাথে আলাপ করেছি। তাদের মধ্যে অনেকের কাছে ব্যাপারটা একটা খেলা খেলা মনে হয়েছিল। অনেকে এর গুরুত্বই বুঝতে পারেনি। তবে কেউ কেউ এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। আবার কাউরে কাউরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সমিতিতে এনেছি। আবার সমিতি করতে যারা রাজী হয়েছে, তারাই যারা প্রথমে এটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি তাদেরকে বোঝাল। শুরু থেকেই অনেকেই আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। কেউ চলে যায় আবার কেউ আসে। কয়েকজন চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। যাদের নিয়ে শুরু করেছিলাম তাদের মধ্যে বর্তমানে পাঁচ জন নাই (২০০৩ সালের অক্টোবর নাগাদ)।” বললেন শাহানা। এ প্রসঙ্গে এ কথাটি বলা দরকার, এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেয়েদেরকে সমিতি করে মুষ্টিচাল জমানোর পরামর্শ দিলেও বা অনেক নারী বিভিন্ন সূত্রে বিষয়টি জানার পর কয়েকজন একসাথে হয়ে মুষ্টিচাল জমালেও, শাহানা স্পষ্ট করেই বলেন যে সমিতি করে মুষ্টিচাল জমানোর ভাবনা তাঁর নিজেরই। তাঁর গ্রামে ও আশেপাশের এলাকায় মহিলারা রান্নার আগে মুঠিচাল উঠিয়ে রাখার বহু প্রাচীন প্রথাটি এখনো চালিয়ে আসছেন, চিরদিনের সেই অভ্যাসের মধ্যে বেড়ে ওঠা শাহানার মাথায় তাই এই ভাবনাটি আসাটা হয়তো প্রায় অবধারিতই ছিল।

২০০০ সালের জুলাই মাসে সমিতিটি শাহানার বাড়ির আশেপাশের ১০ জন মহিলা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। হাংগার প্রজেক্টে প্রশিণ নেয়ার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁরা মুষ্টিচাল সমিতির কাজ শুরু করেন। তাঁরা ওই বছরের ১লা জুলাই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমিতির যাত্রা শুরুর দিন হিসাবে চিহ্নিত করেন। তারপর বাড়তে বাড়তে সদস্য সংখ্যা ২৯-এ উন্নীত হয় । মাসদুই পরে চাল-বিক্রি করে সঞ্চিত পুঁজি যুববন্ধন সমিতির পুঁজির সাথে যোগ করে তাঁরা যৌথভাবে স্যানিটারি পায়খানার রিং বানানোর কাজে নামেন। কাজ দেখতেন দুই সমিতিই তবে লগ্নি বেশি ছিল যুববন্ধন সমিতির। এ ছাড়া তাঁরা পাওয়ার টিলারের ব্যবসাও শুরু করেন Ñ
২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পর এলাকার রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়। যুববন্ধন সমিতিটি মূলত যাঁর নেতৃত্বে চলত তাঁকে এলাকা ত্যাগ করতে হয়, তাছাড়া অন্যান্য সমস্যাও হয়, ফলে মুষ্টিচাল সমিতির কাজ অনেকটা তিগ্রস্ত হয়। “নির্বাচনের পর (জাতীয় সংসদ নির্বাচন অক্টোবর ২০০১) এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল,” জানান শাহানা। “তখন আমাদের সদস্য সংখ্যা ২৯ থেকে ১৬তে নেমে আসে। সদস্যরা সবাই সঞ্চয় বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে বেশিদিন নয়, মাস দুয়েক পর আবার সবাই জড়ো হয়ে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করলাম, ‘না, সঞ্চয় বন্ধ করা চলবেনা।’ ” অক্টোবর, ২০০৩ সালে সমিতির সদস্য ছিল ১৬ জন।” (তবে এপ্রিল ২০০৫-এ এই প্রতিবেদনটির চূড়ান্ত যাচাইপর্বে সদস্য সংখ্যা ১৪তে নেমে এসেছিল)

মুষ্টিচাল সমিতি যেভাবে চলে

মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি কাজ করতে করতে পথ ঠিক করে অগ্রসর হচ্ছে। শাহান কবির যেমনটা বলছেন, “আমরা তো কাউরে কিছু বলে কয়ে সমিতি বানাই নাই। নিজেরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবার থেইকা মুঠ চাইলা সবাই একলগে জমা করব। এখানকার সবাই নিজেরা নিজেরা চাল জমা করত। সমিতি করার পর তফাৎ হলো যে তখন থেকে একসাথে জমা করতে শুরু করলাম।”

উদ্যোক্তারা বলেন এ সমিতি করার উদ্দেশ্য একটাই, নারীদের কিছু একটা করে আত্মনির্ভর হওয়া। মূল উদ্যোক্তার মনে হয়েছিল এই সমিতি করতে পারলে তাঁদের একটা শক্তি হবে, নিজস্ব একটা পুঁজি থাকবে যা কারো দয়ায় পাওয়া না বা যার উপর সংসারের অন্য কারো কোনো দাবী থাকবে না। “এরকম তো থাকাই উচিত,” বলেন শাহানা। “যে কোনো কিছুতে স্বামীর মুখের দিকে চাইয়া থাকা ছাড়া আমাদের তো আর গত্যন্তর নাই। স্ত্রীর নিজস্ব একটা পুঁজি থাকলে সেই সংসারে তার একটা আলাদা মর্যাদা থাকে। সেই কথা আমি সবাইকে বুঝাইছি।”

জুলাই ২০০০-এ শুরু করার পর প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠাতা ১০ জন সদস্য যাঁর যাঁর নিজের ঘরে চাল জমিয়ে মাস গেলে সবটা শাহানার কাছে জমা দিতেন। তিনি একটা বড় ডেকচিতে সেই চাল রাখতেন এবং সুযোগমতো  সেখান থেকে চাল বিক্রি করতেন। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল এটা পোষাচ্ছে না। চাল কিনতে যাঁরা আসতেন, তাঁরা অভাবী মানুষ। অনুনয়-বিনয় করে তাঁরা চালের দাম কমাতেন, শাহানাও তাঁদের চাপ দিতে পারতেন না। সুতরাং ন্যায্য দাম না পেয়ে সমিতি তি গুণতে থাকে।  শেষে সকলে মিলে ঠিক করলেন যে, যে যার নিজের সঞ্চিত চাল বিক্রি করে প্রতি মাসে সমিতিতে ২৫ টাকা করে জমা দেবেন। এ নিয়মটিই এখনো চলছে। সমিতিতে ভর্তির সময় দিতে হয় এককালীন দুই টাকা।

মুষ্টিচাল সমিতির সভাপতি রেহানা বেগম, সহ-সভাপতি রহিমা বেগম। শাহানার মূল দায়িত্ব কোষাধ্যরে। তিনি বলেন, ‘কোষাধ্যরে কাজটা কঠিন। লেখাপড়া জানা দরকার। সমিতির মইধ্যে এই দায়িত্ব নেবার সাহস কেউ করতেছে না।’

সমিতির সদস্যরা সাধারণত শাহানা কবিরের বাসায় বৈঠক করেন। একসময় শাহানা নিয়মিত সমিতির সদস্যদের  লেখাপড়া  শেখাতেন। কয়েকজনকে তিনি বর্ণ চেনা, বর্ণ লেখা আর নাম সই করা শিখিয়েছেন। তবে ব্যস্ততার কারণে শাহানা এখন আর এ কাজটা পারছেন না। এ ছাড়া শাহানা সমিতির বৈঠকগুলোতে স্বাস্থ্য ও শিা সংক্রান্ত তথ্য বিতরণ করেন। তবে সদস্যরা সাংসারিক দায়িত্বের চাপেই মূলত লেখাপড়া শেখা কিংবা অন্যান্য দৈনন্দিন বিষয়ে আলোচনা সভা বা বৈঠক করার জন্য সময় দিতে পারেন না। সমিতিকে প্রয়োজনীয় সময়ও তাঁরা দিতে পারেন না। শাহানা নিজের চাকরি করেন, আবার ঘরও সামলান। বৈঠকগুলো সুতরাং অনিয়মিত।

সমিতির হিসাব-নিকাশ নিয়ে বসাটা একটা বড় উপল্য, যেমনটা বলছেন শাহানা, “সমিতির অর্থের হিসাব-নিকাশ আমিই রাখি। আমাদের অনিয়মিত বৈঠকে সবাইকে হিসাব-নিকাশ দেখাই। সবার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বলি। এরকম তো গ্রামে-গঞ্জে মেয়েরা বসে। কেউ কেউ পাটি বানাইতে বানাইতে কথা বলে। কাজের অবসরে সবাই জড়ো হয়। আমরাও সেরকম বসি।”

২০০৫-এর এপ্রিল পর্যন্ত সমিতিটি সেভাবেই চলে আসছে। তবে এই সময়টাতে এসে মাসে একবারের বেশি সমিতির সদস্যরা বসতে পারেন না, এর একটি প্রধান কারণ শাহানা কবিরের সাংসারিক ব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।

সমিতির কোনো ব্যাংক একাউন্ট ২০০৫-এর এপ্রিল পর্যন্ত হয়নি। শুরু থেকেই শাহানা কবিরের নিজস্ব একাউন্টেই সমিতির টাকা-পয়সা রাখা হয়। শাহানার একাউন্ট আছে চৌমুহনীর ইসলামী ব্যাংকে। সমিতির নিজস্ব একাউন্ট করার ব্যাপারে বেশ কয়েকবার আলোচনা হলেও এখনো হিসাব-নিকাশে তেমন সমস্যা হচ্ছে না বলে সমিতির জন্য আলাদা একাউন্ট খোলা হয়নি। সমিতির একটি গঠনতন্ত্রও ইতিমধ্যে খসড়া করা হয়েছে। “গঠনতন্ত্র থাকলে সদস্যরা সেই নিয়ম ধরেই চলবে, সমিতিতে অনিয়ম হবে না, এসব চিন্তা করেই এটা বানিয়েছি,” জানান শাহানা।

মুষ্টিচাল সমিতির সঞ্চিত পুঁজির ব্যবস্থাপনা

মুষ্টিচাল সমিতি নিজেদের টাকা সাধারণত নিজেদের মধ্যে বা বাইরে ঋণ দেয় না। মাঝেমধ্যে নিতান্ত জরুরি প্রয়োজনে সমিতির সদস্যরা সর্ব্বোচ্চ ১,০০০.০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। সুদমুক্ত এই ঋণের টাকা তাঁকে এক মাসের মধ্যে ফেরত দিতে হয়। সাধারণত গুরুতর পারিবারিক প্রয়োজনেই সদস্যরা এই ঋণ নিয়ে থাকেন। এখন পর্যন্ত কারোর ক্ষেত্রে টাকা ফেরত দিতে এক মাসের বেশি সময় লাগেনি বলে সমিতির সদস্যরা জানান।
২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই মুষ্টিচাল সমিতি সদস্যদের জমানো টাকা যুববন্ধন বহুমুখী সমবায় সমিতির পুঁজির সাথে যোগ করে যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করে। সমিতির সদস্যরা জানান, এই সময় নাগাদ সমিতির সঞ্চয় দাঁড়ায় ১৫ শ টাকা। পরে যাঁরা সমিতিতে ঢুকেছিলেন তাঁরা ২০০০ সালের জুলাই মাস ধরেই চাঁদা শোধ করাতে সমিতির এই পরিমাণ টাকা জমা হয়। এই টাকার সাথে যুক্ত হয় যুববন্ধন সমিতির নিজস্ব পুঁজি ৮,৫০০.০০ টাকা। এছাড়া দুটি সমিতি যৌথভাবে কমিউনিটি এডভান্সমেন্ট ফোরাম (সিএএফ-ক্যাফ) নামে স্থানীয় একটি এনজিও-র কাছ থেকে ১০,০০০ টাকা ধার নেয়। সর্বমোট এই ২০,০০০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁরা শুরু করেন স্বাস্থ্যসম্মত কুয়া পায়খানার সরঞ্জাম তৈরি ও পাওয়ার টিলার ভাড়া দেয়ার ব্যবসা ’

“আমরা মিস্ত্রি দিয়ে পায়খানার রিং আর পিলার বানাতাম আর সেগুলো বিক্রি করতাম,” ব্যাখ্যা করেন শাহানা। “এতে দুইটা কাজ একসাথে হতো। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার সংখ্যা বাড়ছিল আর আমাদের আয়ও হচ্ছিল। তাছাড়া পাওয়ার টিলার এখানে কাজে কৃষি কাজে লাগে। সেই পাওয়ার টিলার ভাড়া দিয়েছি।” আবু তাহের নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গা লিজ নিয়ে সেখানে এই রিং ও পিলার বানানোর কাজ চলত। ২০০১-এর অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে কিছু স্থানীয় চাঁদাবাজ রিং বানানোর কাজে বাধা দেয়, বলে তাদেরকে চাঁদা না দিলে রিং বানাতে দেয়া হবে না। তাছাড়া যুববন্ধন সমিতির পরিচালক ও মুষ্টিচাল সমিতির কিছু সদস্যের পরিবার রাজনৈতিক চাপে পড়ে যায়, এর ফলে ব্যবসায়ে খাটানো টাকা মার যাওয়ার ভয়ে মুষ্টিচাল সমিতির কিছু সদস্য তাঁদের লগ্নি তুলে নিয়ে সমিতি ছেড়ে যান। এভাবে রিং ও পিলার বানানোর কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। এসব অস্থিরতার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় পাওয়ার টিলারের ব্যবসাও।

মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা জানান, যুব-বন্ধন সমিতির সাথে তাঁদের শর্ত ছিল, বিনিয়োগ অনুযায়ী লাভ ভাগ হবে। যখন ব্যবসা ছিল তখন সমিতির সবাই মিলে তদারকির কাজটা করতেন। নিয়মিত বৈঠকে বসে দুই সমিতির সদস্যরা কাজের পর্যলোচনা করতেন। অর্ডার পেলে রিং বানানো হতো। ক্রেতা এসে নিয়ে যেতেন। হিসাব-নিকাশে সমস্যা হতো না কারণ রিং কত দিয়ে বিক্রি হয়, কয়টা বানানো হয় এ সব সবাই জানতেন, পারস্পরিক বিশ্বাসও ছিল। তবে ব্যবসাটি আচমকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাঠে অনেক টাকা অনাদায়ী রয়ে যায়।

ব্যবসা বন্ধ হওয়ার মাস দুয়েক পর থেকে মুষ্টিচাল সমিতির অবশিষ্ট সদস্যরা আবার একত্র হয়ে সঞ্চয় করতে শুরু করেন। তাঁরা মাঠে বাকি পড়া টাকা উঠিয়ে আনতে উদ্যোগ নেন, বিনিয়োগ আর লাভের হিসাব-নিকাশ করতে বসেন। শাহানার হিসাবে এক বছরে এই ব্যবসায়ে দুই সমিতি যা বিনিয়োগ করেছিল তাতে আট থেকে দশ হাজার টাকা লাভ হওয়ার কথা ছিল। শেষতক তাঁরা বিনিয়োগকৃত ২০,০০০ টাকা পুঁজির পুরোটা তুলতে পারলেও লাভ তুলে আনতে পেরেছিলেন হাজার সাতেক টাকা।

২০০৩-এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাঁরা সমিতি গোছানো, টাকা জমানো ও বকেয়া টাকা তোলার কাজ করেন। তারপর ২০০৩-এর মাঝামাঝি সময়ে মুষ্টিচাল সমিতি ও যুববন্ধন সমিতি তাদের পুঁজি আবার একত্র করে যৌথভাবে স্থানীয় ওয়েভ মিনারেল-ওয়াটার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। শাহানা জানান মুষ্টিচাল সমিতি দেয় ৯,৫০০ টাকার মতো এবং যুব-বন্ধন সমিতি দেয় ১৩,০০০.০০ টাকার কিছু বেশি পুঁজি । শর্ত ছিল কোম্পানি ২০০৪-এর মে মাসে ৫০০০.০০ টাকা লাভ দেবে।

২০০৫-এর এপ্রিলে  এই গবেষণা-প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় জানা যায় যথাসময়ে এই লাভসহ সম্পূর্ণ পুঁজি তুলে এনে মুষ্টিচাল সমিতি ও যুব-বন্ধন সমিতি এখন যৌথভাবে মোট প্রায় ৩০,০০০.০০ সুদে খাটিয়েছেন। একটি জায়গাতেই তাঁরা পুরো টাকাটা ধার দিয়েছেন। এর প্রায় ১০ হাজার টাকা মুষ্টিচাল সমিতির আর ১৩ হাজার টাকা যুববন্ধন সমিতির আদি পুঁজি বাকি ৭০০০ টাকা স্যানিটেশন ব্যবসা থেকে আসা লাভ। ব্যবসার শর্ত, ঋণগ্রহীতা ২০০৫-এর মে মাসে অর্থাৎ এক বছর শেষে হাজারে ৩০০ টাকা করে সুদ দেবেন। মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা আশা করছেন ২০০৫-এর মে মাসে তাঁরা লভ্যাংশ পাবেন। যাঁকে টাকাটা দেয়া হয়েছে তাঁর ওপর দুই সমিতির সকলের আস্থা আছে। এ ছাড়া শাহানা কবির জানান, এলাকার পরিবেশ অনেক দিন হয় আবার শান্ত হয়েছে, তাঁরাও সমিতির কাজ করতে পারছেন।

২০০৫-এর জুন মাসে মুষ্টিচাল সমিতির পাঁচ বছর পূর্তি হবে। এ উপলে মুষ্টিচাল সমিতি ও যুব-বন্ধন সমিতি একত্রে বসে গত পাঁচ বছরের ব্যবসার লাভ বন্টন করে নেবে। এখনো পর্যন্ত মুষ্টিচাল সমিতির টাকা শাহানা কবিরের মাধ্যমেই ব্যবহার হয়েছে।

 এদিকে গোড়ায় নিজেদের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার সরঞ্জাম তৈরির ব্যবসা চালানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা বলেন, রিং-পিলার এগুলো বানানোর জন্য যুববন্ধন সমিতির ছেলেরা নিজেরা ইট ভাঙতেন, নিজেরাই হাতে হাতে সব যোগাড়-যন্ত্র করতেন দেখে পাড়া-প্রতিবেশিরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন যার ফলে এসব তরুণ অপমান বোধ করতেন, বিব্রত হতেন। তাছাড়া দাম আদায়ের জন্য ক্রেতাদের পেছনে পেছনে প্রচুর ঘুরতে হতো। এসব অভিজ্ঞতার কারণেই তাঁরা শেষ পর্যন্ত নিজেরা ব্যবসা করা ছেড়ে কারো তৈরি ব্যবসাতে পুঁজি খাটাতে আগ্রহী হয়েছেন। সুদের ব্যবসাতে নেমেছেন মূলত দ্রুত পুঁজি বাড়ানোর লক্ষ্যে।

সমিতির সদস্যরা
২০০৩-এর অক্টোবর নাগাদ স্টাডি চলাকালীন মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির ১৬ জন সদস্যের মধ্যে একটি প্রাথমিক জরিপ করা হয়। এঁদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত এবং সবাই গৃহিনী।

১. শাহানা কবির (৪৩), প্রতিষ্ঠাতা মূল উদ্যোক্তা এবং কোষাধ্য। । তিনি পেশায় স্কুল শিকিা, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। তিনিই পরিবার পরিচালনা করেন। জমি আছে এক একর আট শতাংশ, ফসল পান। তাঁদের দুই সন্তান রয়েছে।

২. রেহানা বগম (৪১), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সভাপতি । তিনি এইচএসসি পাশ। (এপ্রিল ২০০৫-এ স্বামী নূরুল আলম একটি প্রাইভেট কোম্পানির হিসাব বিভাগে চাকরি করছিলেন। রেহানার নিজের আছে এক একর আট শতাংশ জমি এবং স্বামীর আছে ৩০ শতাংশ জমি।)

 
৪. রহিমা বেগম (৩০), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সহ-সভাপতি। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। স্বামী জাফর আহমেদ পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এ ছাড়া একটি ছোট সোনার অলঙ্কারের দোকান ভাড়া দেয়া আছে। জমি আছে নয় শতাংশ। পারিবারিক আয় মাসে ২৫০০-৩০০০ টাকা। রহিমা বেগম ব্র্যাক-এর ুদ্র-ঋণ সমিতির সদস্য, ঋণের টাকা সোনা বন্ধকীর ব্যবসায়ে খাটান  স্বামীর ব্যবসাতেই খাটান। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের ১৩ বছর বয়সী চার সন্তানের বড় মেয়েটি সপ্তম শ্রেণীতে এবং এক ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। পরের দুটি ছেলেমেয়ে ছোট, এখনো স্কুলে যায় না।)

৫. আয়েশা খাতুন (৪৮), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি নাম স্বার করতে পারেন। স্বামী নূর ইসলাম চৌমুহনীতে জুটমিলের শ্রমিক ছিলেন (এপ্রিল ২০০৫-এ তিনি ছিলেন বেকার।) জমি আছে ৭২ শতাংশ, ৭০ শতাংশে কৃষি আবাদ করেন। এক ছেলে এক মেয়ে তাঁদের। (স্বামীর চাপে এবং সমিতির সঞ্চয় দিতে না পেরে আয়শা খাতুন ২০০৪ সালে সমিতি ছেড়ে দিয়েছেন। এপ্রিল ২০০৫-এ কুড়ি-একুশ বছর বয়সী বড় ছেলেটি ছিলেন পরিবারের মূল উপার্জনকারী, কাস সেভেন/এইট পর্যন্ত পড়ে তিনি দোকানে কাজ করছিলেন; ১৬/১৭ বছর বয়সী মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে বাসায় বসা।)

৬. মরিয়ম বেগম (৪০), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি নাম স্বার করতে পারেন। স্বামী আব্দুল মতিন, পেশায় দিনমজুর। জমি আছে নয় শতাংশ। স্বামীর আয়েই মূলত সংসার চলে। (স্বামীর চাপে মরিয়ম বেগম ২০০৪ সালে সমিতি ছেড়ে দিয়েছেন। এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের একমাত্র ছেলের বয়স ১৯/২০ বছর, বেকার; তিন মেয়ের বড়টি কাস ফোরে পড়ে, অন্য দুজন ছোট।)

৭. আমেনা বেগম (৪২), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি লিখতে ও পড়তে পারেন। (এপ্রিল ২০০৫-এ স্বামী খুরশীদ আলম চৌমুহনীতে জুটমিলে ফোরম্যানের চাকরি করছিলেন। জমি আছে আট শতাংশ। মাসিক পারিবারিক আয় ৫০০০ টাকা। তাঁদের দুই ছেলের বড় জন দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে দোকানে কাজ করছে; বারো বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে পড়ছে কাস ফাইভে; ছোট ছেলে কাস ওয়ানে।)

৮. তাহেরা বেগম (৩২), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি অল্প অল্প বাংলা পড়তে জানেন। স্বামী মৃত আমীর আহমেদ। জমি আছে নয় শতাংশ। তাহেরা বেগম ব্র্যাক-এর ক্ষুদ্র-ঋণ সমিতির সদস্য, ঋণের টাকা সোনা বন্ধকীর ব্যবসায়ে খাটান। আয় খুব সামান্য। দুই ছেলে দুই মেয়ে তাঁর। (এপ্রিল ২০০৫-এ প্রাইমারি-পাশ ১৫/১৬ বছর বয়সী বড় ছেলেটি বেকার; তের-চোদ্দ বছর বয়সী বড় মেয়ে কাস সেভেনের, দশ বছর বয়সী দ্বিতীয় মেয়েটি পড়ে চতুর্থ শ্রেণীর এবং সাত বছর বয়সী ছোট ছেলেটি প্রথম শ্রেণীর ছাত্র।) বিধবা তাহেরাকে তাঁর ভাইয়েরা দেখাশুনা করেন।

৯. ফয়জুন্নেসা (৬০), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। সমিতির সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ এই সদস্য নিরর। স্বামী রমজান আলী ুদ্র ব্যবসায়ী, বাজারে শাক-সবজি বিক্রি করেন। জমি আছে ২৫ শতাংশ। তাঁদের তিন মেয়ে তিন ছেলে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ি থাকে। এক ছেলের বিয়ে হয়েছে, বাবার সাথেই থাকেন। বড় দুই ছেলে বাবার সাথে সবজির কারবার করেন, বড় ছেলে দিনমজুরিও করেন। (এপ্রিল ২০০৫-এ ১৬/১৭ বছর বয়সী ছোট মেয়েটি নবম শ্রেণীতে এবং ছোট ছেলেটি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছিল, একলাশপুর হাই স্কুলে।)

১০. শিরিণ (৩২), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি নবম শ্রেণী পাশ। স্বামী  আবদুল করিম একজন কাঠমিস্ত্রি। জমি আছে ৩০ শতাংশ। পারিবারিক আয় মাসে গড়ে ৩০০০ টাকা। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের দুই সন্তানের বড় মেয়ে কাস ফাইভে পড়ছিল।)

১১. মামুনা বেগম (৩৫), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ। স্বামী আবদুর রহিম একজন নির্মাণ-শ্রমিক। জমি আছে ৩০ শতাংশ। পারিবারিক আয় মাসে গড়ে ৩০০০ টাকা। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের দুই সন্তানের বড় মেয়েটি চতুর্থ শ্রেণীর এবং ছয় বছর বয়সী ছেলে শিশু শ্রেণীতে পড়ছিল ।)

১২. নুরুন্নেছা (৩৫), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ। স্বামী ইসমাইল হোসেন ঢাকায় একটি কাঁচ-কারখানায় চাকরি করছিলেন। জমি আছে ৩০ শতাংশ, এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের তিন সন্তানের বড় মেয়েটি ও ছেলেটি মাদ্রাসায় পড়ছিল; ছোট মেয়েটি শিশু বয়সী।)

১৩. নুরুন্নাহার (২৫), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ। স্বামী দিনমজুরি করে সংসার চালান। জমি আছে আট শতাংশ। মাসিক পারিবারিক আয় গড়ে ২০০০ টাকা। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের দুটি সন্তানই খুব ছোট, স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি।)

১৪. কুলছুম (২০), সদস্য হয়েছেন ২০০৩ সালে। তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। স্বামী আবুল কালাম, পেশায় গাড়িচালক। প্রাইভেট কোম্পানির মাইক্রো চালাতেন। (এপ্রিল ২০০৫-এ তিনি সৌদি আরবে কর্মরত। ধারদেনা করে, জমি বন্ধক রেখে বিদেশে গেছেন, তখনো টাকা শোধ করতে পারেননি। জমি  আছে ১৬ শতাংশ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে শ্বশুর পরিবারকর্তা। একমাত্র ছেলেটির বয়স চার বছর।)

১৫. বেগম নূর-ই-জিন্নাত শাকিলা (২৮), সদস্য হয়েছেন ২০০৩ সালে। তিনি বিএ পাশ। স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান বেগমগঞ্জ থানারই আরেকটি ইউনিয়নে অবস্থিত কাজীরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক। জমি আছে ১৬ শতাংশ। পরিবারটি স্বচ্ছল, ঘরে রেডিও, টিভি, ড্রেসিং টেবিল, ইত্যাদি রয়েছে। (এপ্রিল ২০০৫ পর্যন্ত তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না।)

১৬. বিবি রহিমা (৪০), তিনি নাম স্বার করতে জানেন। স্বামী আবদুর রশিদ একজন দিনমজুর। তাঁদের আছে দুই-আড়াই শতাংশ ভিটা-জমি মাত্র।

১৭. সাকেরা বেগম (৩৫) তিনি নাম স্বার করতে পারেন। স্বামী সালাউদ্দিন রিক্সাচালক, রিক্সাটি তাঁর নিজের। জমি আছে পাঁচ শতাংশ। মাসিক আয় গড়ে ২০০০ টাকা। এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের তিন সন্তানের বড় তেরো বছর বয়সী মেয়েটি একলাশপুর হাইস্কুলে, এবং দশ বছর বয়সী ছেলে ও সাত বছর বয়সী মেয়েটি একলাশপুর প্রাইমারি স্কুলে পড়ছিল।

২০০৩-এর অক্টোবর মাসে স্টাডি চলাকালে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির ১৬ জন সদস্যের মধ্যে তিনজনের বাড়িতে কোনো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ছিল না। অধিকাংশ সদস্যই গৃহিণী। প্রতিটি পরিবার হাঁস-মুরগি পালন করে, এ থেকে সামান্য আয় হয়। গ্রামের এই মহিলাদের জীবন একেবারে নিজস্ব গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। সমিতির সদস্যদের মধ্যে অনেকেই বেত ও বাঁশের কাজ করেন যা নিতান্ত সাংসারিক কাজে ব্যবহার হয়। কেউ কেউ সেলাই জানেন। সমিতির সদস্য হওয়ার পর পড়ালেখার প্রতি এঁরা প্রায় সকলেই খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সবাই চান সমিতির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে।

সদস্যদের পরিবারে প্রতিক্রিয়া
সমিতিটি করার সময় মূল উদ্যোক্তা শাহানা কবির নিজেই পরিবারের মাথা হওয়াতে কোনো সামাজিক বা পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হননি, তবে তিনি যখন সমিতিটি করতে উদ্যোগী হন তখন আশেপাশে তাঁর পাড়া-প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনরা মন্তব্য করেছিলেন, এসব করে লাভ নেই, দুদিন পরেই সমিতি ভেঙে যাবে। যাঁরা তাঁর সাথে সমিতিতে যোগ দিয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ কিছুটা হলেও পারিবারিক বাধার মুখে পড়েছিলেন। আবার কেউ কেউ স্বামী বাধা দেবেন মনে করে তাঁকে আগে বলেননি, কিন্তু স্বামী যখন জানতে পেরেছেন তখন উৎসাহই দেখিয়েছেন। নিচে সমিতির কয়েকজনের অভিজ্ঞতার কথা সংক্ষেপে দেয়া হলো।

 

ঘটনাচিত্র -১
এপ্রিল ২০০৫-এ এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন মরিয়ম বেগম আর সমিতিতে ছিলেন না। তাঁর চার সন্তান। দিনমজুর স্বামী আবাদুল মতিনই সংসারের মূল উপার্জনকারী। ঘরসহ ভিটাজমি আছে নয় শতাংশ, কোনো কৃষিজমি নেই। স্বামী দিনমজুরি করেন বলে বর্ষা-বাদলে বা তাঁর অসুখ-বিসুখ হলে পরিবারের আয়ও বন্ধ হয়ে যায়। তখন ধারদেনা করেই সংসার চালাতে হয়। ঘরে সম্পদের মধ্যে দুচারটি হাঁড়ি-পাতিল, একটি শোয়ার চৌকি ও কাঁথা-বালিশ। ঘরের মধ্যেই মরিয়ম বেগম কয়টি হাঁস ও মুরগি পালন করেন, তা থেকে বছরে চার/পাঁচ শ টাকা আয় হয়। তাঁদের বাড়িতে কোনো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। পরিবারে প্রায়ই রোগ-বালাই লেগে থাকে। এর জন্য তাঁরা পানিপড়া ও তাবিজের উপর নির্ভর করেন। মরিয়ম বেগম সরকারের টোটাল লিটারেসি মুভমেন্ট (টিএলএম)-এর অধীনে পরিচালিত শিাকেন্দ্র থেকে নাম স্বার করা শিখেছেন। পাশের বাড়িতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাঁরা টিভি দেখেন। খবর নিয়মিত শোনা হয় না, তবে উল্লেখযোগ্য খবর শুনে থাকেন। টিভিতে নাটক হলে খুব আগ্রহভরে তা দেখেন। তিনি কোনো পত্রিকার নামও জানেন না।

সমিতিতে যোগ দিয়ে মরিয়ম বেগম চেয়েছিলেন এর মাধ্যমে কিছু আয় করে সে টাকা দিয়ে নিজে কিছু করতে। তিনি কোনো কোনো সময় পরিবারে নিজের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। মরিয়ম জানান পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি হলেও তা কখনো মাত্রা ছাড়ায়নি তবে তিনি প্রায়ই স্বামীর ছোটখাট মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এর জন্য স্বামীর সঙ্গে মাঝে মাঝে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে তিনি চান পরনির্ভরশীল না হয়ে নিজে কিছু করে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে যদিও এই এলাকার অতি গরিব পরিবারে আলাদাভাবে নিজস্ব কাজের জন্য কিছু করা মেয়েদের পে খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার।

মরিয়ম বেগমের স্বামী স্ত্রীর সমিমিতে  যোগ দেয়ার কথা কিছুই জানতেন না। সমিতিটি সম্পর্কে জানাজানি হলে মরিয়মের স্বামীও এ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং বলেন যে মুঠ চাইলা ঘরের লক্ষ্মী, দেয়া উচিত না। তাছাড়া মাসে ২৫ টাকা করে সমিতির চাঁদা শোধ করার ব্যাপারে স্বামীর বিশেষ আপত্তি ছিল। কিন্তু সমিতি করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন মরিয়ম, এর একটি কারণ সমিতিতে যোগ দেয়ার বছরখানেকের মাথায় তিনি সমিতি থেকে ঘর তোলার জন্য ৩০০ টাকা ধার পান। প্রয়োজনের মুহূর্তে সুদমুক্ত এই টাকা পাওয়ার ব্যাপারটি তাঁকে আরো বেশি করে সমিতিমুখী করেছিল, কিন্তু মূলত স্বামীর চাপেই মরিয়ম বেগম ২০০৪-এর মাঝামাঝি সমিতি ছাড়তে বাধ্য হন।

ঘটনাচিত্র - ২
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন এবং সমিতির সভাপতি রেহানা বেগম (৪১) সমিতির কাজে আসেন স্বামী নুরুল  আলম (৫৫)-এর অজান্তে। তিনি বলেন, “যখন সমিতির ব্যাপারে সাংবাদিকদের প থেকে খোঁজ-খবর শুরু হয়, তখন আমার স্বামী ব্যাপারটি জানতে পারেন।” কিন্তু জানার পর নুরুল আমিন রাগ করেননি। যদিও আগে তিনি মনে করতেন সমিতির পেছনে সময় আর শ্রম দিয়ে কোনো লাভ হয় না, মুষ্টিচাল সমিতিটিকে চোখের সামনে দাঁড়াতে দেখে তাঁর ধারণা বদলিয়েছে। তিনি সমিতিটির ওপরে অনেকটা আস্থা পেয়েছেন। সমিতির সদস্যরা যখন হাতের কাজ শিখে সেগুলো বানিয়ে বিক্রি করার পরিকল্পনা করছিলেন এবং এজন্য জায়গা খুঁজছিলেন তখন নুরুল আমিন সেই জায়গা দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। যাই হোক, সেই পরিকল্পনা এখনো বাস্তবে রূপান্তরিত হয়নি।

ঘটনাচিত্র - ৩
সমিতির একমাত্র বিএ পাশ সদস্য বেগম নূর-ই-জিন্নাত শাকিলা। তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক। তাঁদের  সন্তানাদি নেই। নূর-ই-জিন্নাত একজন গৃহিণী। তবে সংসার নির্ঝঞ্ঝাট হওয়ায় বাড়িতে গরু-হাঁস-মুরগি এসব পালন করতে পারেন না। তাঁদের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা রয়েছে। অসুখ-বিসুখে তাঁরা সাধারণত ডাক্তারের কাছেই যান। নিজেদের সাদা-কালো টেলিভিশনে তাঁরা অনুষ্ঠান দেখেন, খবর দেখেন নিয়মিত। টিভিতে বেশি দেখেন নাটক ও গান। প্রতিদিন পত্রিকা না পড়লেও প্রায়ই পড়েন। নূর-ই-জিন্নাত পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো স্বামীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিয়ে থাকেন, অর্থাৎ পারিবারিক সিদ্ধান্তগুলোতে তাঁর অংশগ্রহণ ও মতামত থাকে। স্বামীর সঙ্গে তাঁর বেশ সু-সম্পর্ক রয়েছে। তিনি স্বামীর কোনো নির্যাতনের শিকার কখনো হননি। সমিতি করার ব্যাপারে স্বামী তাঁকে উৎসাহই যুগিয়েছেন।

নূর-ই-জিন্নাত মনে করেন পরনির্ভরশীল হয়ে থাকা নারীদের জন্য খুরই অপমানকর, খারাপ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যই মূলত তিনি একটি স্কুলে শিকের চাকরি নেন কিন্তু চাকরিটি পছন্দ না হওয়াতে ছেড়েও দেন। এখন তিনি উপার্জনের জন্য কোনো কাজ করছেন না। সর্বেেত্র তিনি স্বামীর সহযোগিতা পেয়ে আসছেন।

ঘটনাচিত্র - ৪
এপ্রিল ২০০৫-এ এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন আয়েশা খাতুন আর সমিতিতে ছিলেন না। সংসারে আর্থিক সঙ্কট প্রকট। পাটকল শ্রমিক স্বামী খুরশীদ আলম এখন বেকার, ছেলে দোকানে কাজ করে সংসার চালায়। আয়েশা খাতুন সারাদিন সংসারের কাজ করে অন্য কিছু করার সময় পান না। কয়টা হাঁস-মুরগি পালন করেন। এ থেকে বছরে প্রায় হাজার খানেক টাকা আয় হয়। তাঁদের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। তিনি টিএলএম কর্মসূচির আওতায় নাম স্বার করতে শিখেছেন। তাঁর রেডিও-টেলিভিশন শুনা বা দেখা হয় না। পত্রিকার নামও জানেন না।

পরিবারের কোনো কাজে আয়েশা খাতুনের মতামত একেবারেই নেয়া হয় না, স্বামীই সব সিদ্ধান্ত নেন। স্বামীর কড়া শাসনে নিজে কিছু করতে পারেন না, সব সময় স্বামীর অনুগত হয় থাকতে হয়। মাঝে মাঝে স্বামী শারীরিক নির্যাতন করেন আর সার্বণিক মানসিক নির্যাতন তো রয়েইছে। কোনো কাজেই স্বামী কিংবা পরিবারের সহযোগিতা পান না। তিনি সমিতির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্বামীর চাপে ও সমিতির টাকা শোধ করতে না পেরে ২০০৪-এর মাঝামাঝি সমিতি ত্যাগ করেন।


মুষ্টিচাল সমিতি ভবিষ্যতে যা করতে চায়

মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা আশা সম্পর্কে যা জানিয়েছেন:
ক্স যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁরা সমিতির নিবন্ধিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চান।
ক্স আর দুই বছর পর তাঁরা সমন্বিত পুঁজি দ্বারা একটি বিক্রয় কেন্দ্র খুলতে চান, যেখানে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির সদস্যাদের হাতের কাজ করা সামগ্রী, পোষাক ইত্যাদি বিক্রি হবে। এ জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় প্রশিণ পেতে চান। তাঁরা চান সেলাই, বাটিক আর ব্লক, বাঁশ-বেতের কাজ এসব শিখতে। সমিতির সদস্যরা জানান বহু আগে সরকারের যে দপ্তর এখানকার মেয়েদেরকে এসব প্রশিণ দিয়েছিল তার অফিস ছিল দালানবাড়ি থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। এখন সেখানে তাদের অফিসটি আর নেই। তাই হাতের কাজ শেখানোর একজন ভালো প্রশিক অনেক খুঁজেও তাঁরা এখনো যোগাড় করে উঠতে পারেননি। পেলে তাঁরা অচিরেই হাতের কাজ শেখার কাজটা শুরু করতে পারবেন।

একলাশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান এই গবেষকের সাথে আলাপ হওয়ার আগে এই সমিতিটি সম্পর্কে তেমন অবগত ছিলেন না (২০০৩ সালের শেষ নাগাদ)। তিনি সমিতিটির ব্যাপারে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে বললেন সমিতিটির সাথে আলাপ করবেন। তবে মুষ্টিচাল সমিতির মতোই এলাকার মহিলাদেরকে সংগঠিত করবেন কি না এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “মহিলারা নিজে থেকে উদ্যোগী না হলে করা যাবে না, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।” মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা যে সব প্রশিণ চেয়েছেন সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে তিনি সম্মতি জানালেও কীভাবে করবেন সে নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।

গবেষণা তত্ত্বাবধানকারীর কথা
২০০৫-এর এপ্রিলে এই প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার সময় মুষ্টিচাল সমিতির সদস্য সংখ্যা ১৪-তে নেমে গেছে। স্বামীর চাপেই মূলত কয়েক মাস আগে সমিতি ছেড়ে গেছেন একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মরিয়ম বেগম। আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আয়শা খাতুনও চলে গেছেন, মূলত স্বামীর চাপে এবং অংশত কিস্তির টাকা শোধ চালাতে না পেরে। এঁরা চলে গেছেন ২০০৪-এর মাঝামাঝি সময়ে।
 
দালানবাড়ির গৃহবধূদের উদ্যোগে পরিচালিত মুষ্টিচাল সমিতিটি খুবই ধীরে ও নিজস্ব গতিতে পরিচালিত হচ্ছে। সদস্যদের কয়েকজন মধ্যবিত্ত গৃহিনী হলেও অধিকাংশই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। একেক জন একেক ধরনের পারিবারিক প্রোপট থেকে এসে থাকলেও সবাই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য উদগ্রীব। সবাই চান নিজেকে অন্যের কাছে ছোট না করে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে। সামাজিক পশ্চাদপদতার জন্য এঁদের অনেকেই লেখাপড়া করেননি, অথচ এঁদের মধ্যে আছে লেখাপড়ার বিপুল আগ্রহ। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার ও স্বামীর কাছ থেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, এ অবস্থায় অনেকেই মুষ্টিচাল মহিলা সমিতিতে মুক্তির পথ খুঁজতে চেয়েছেন।

দলবদ্ধ হয়ে সমিতির সদস্যরা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছেন, সবাই চান কিছু একটা করতে। তাঁরা বুঝতে পারছেন পড়ালেখা না জানাটা একটা বড় বাধা। সকলের মধ্যেই জানার আগ্রহ প্রবল। সমিতির সকলে চান বিভিন্ন প্রশিণ নিতে। প্রতিদিন এক মুঠো চাল দিয়ে সঞ্চয় করা খুবই ধীর লয়ের, তবে এর মধ্যে রয়েছে একটা ঐক্যের শক্তি। সমিতিটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য, যে সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে সমিতি ছেড়ে গেছেন তাঁরা এখনো সমিতির বৈঠকগুলোতে আসেন, নিজের ও পরিবারের নানা প্রয়োজনে সমিতির সাথে পরামর্শ করেন, সমিতির সদস্যদের পরামর্শও দেন। অর্থাৎ কাছাকাছি এলাকাতে বাস করায় এবং একসময় সমিতির সাথে থাকায় পরস্পরের ভেতরে যে সখ্য গড়ে উঠেছিল, সমিতির সদস্যপদ ছেড়ে দিলেও তা অনেকটাই অটুট আছে।

সমিতির উদ্যোক্তা এখনো পর্যন্ত সমিতিটির প্রধানতম খুঁটি, একমাত্র খুঁটিও বলা যায়। তাঁর বাইরে এই সমিতি চালানোর নেতৃত্বসুলভ মতা এর অন্যান্য সদস্যের মধ্যে সেভাবে গড়ে ওঠেনি বলেই এই গবেষণা তত্ত্বাবধানকারীর মনে হয়েছে। তবে শাহানা জানিয়েছেন তিনি মনে করেন বেগম নূর-ই-জিন্নাত শাকিলার মধ্যে সমিতি চালানোর কিছু গুণ তিনি দেখতে পেয়েছেন। অপোকৃত কমবয়সী এই সদস্য “বোঝে ভালো, লেখাপড়া বেশি, পরিবারে ঝামেলা কম।” তাঁর আশা আরেকটু বয়স বাড়লে, অভিজ্ঞতা হলে এবং স্থিতি এলে শাকিলা সমিতির অনেক দায়িত্ব নিতে পারবেন।

সমিতির বেশির ভাগ সদস্য কোনো এনজিও থেকে ঋণ নেন না বা সদস্যও না, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে শাহানার দৃঢ় অবস্থানকেই এর কারণ বলে মনে হয়েছে, সমিতির বাকি সদস্যরা যার দ্বারা প্রভাবিত। যদিও মুষ্টিচাল সমিতিটি অতীতে দলবদ্ধভাবে অন্য এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে।

দালানবাড়ির মুষ্টিচাল সমিতি দেশের অন্যান্য এলাকার নারীদেরকেও উদ্বুদ্ধ করছে, সুদূর মাগুরায় এ ধরনের সমিতি গঠন করেছেন মেয়েরা, সুধারামের সুজাপুর এবং হাতিয়াতেও গড়ে উঠেছে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি। পরিশেষে শাহানা কবীরের সূত্র ধরেই বলা চলেবাংলার অবহেলিত নারীরা দালানবাড়ি মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির উদাহরণ ধরে  দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক উন্নতির লক্ষ্যে, দালানবাড়ির অরুণ আলোকে সূর্যোদয় হোক।

Mahmudul Huq Foez
 
আপনজন
 
ভালোবাসার একটি গোলাপ
সাতরাজারই ধন,
কোথায় খুঁজিস ওরে ক্ষেপা
এইতো আপন জন।
নীরবতা
 
নীরবে কেটেছে দিবস আমার
নীরবে কেটেছে রাত,
নীরবে হেনেছে হৃদয় আমার
প্রণয়ের অভিসম্পাত।
রঙ
 
রঙ দেখেছো রঙ ?
শাওন রাতের
নিকষ কালো
অন্ধকারের রঙ !
রঙ দেখেছো রঙ !
কমিউনিটি রেডিও’র অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু (content)
 
কমিউনিটি রেডিও’র অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু (content)
সম্পর্কে অংশগ্রহণমূলক জরিপ
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী একটি দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। নোয়াখালী সদরের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই চর এলাকা। এখানে বাস করে সাধারন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অধিকাংশই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। তাছাড়াও দিনমজুর, রিক্সাশ্রমিক, জেলে প্রভৃতি পেশার মানুষ এখানে বাস করে। খুব কমসংখ্যক নারি কৃষি সহ বিভিন্ন কাজ করলেও তারা মূলত ঘরকন্যার কাজ করে থাকে। ঘর কেন্দ্রিক নানান কাজের সঙ্গেও এরা জড়িত। এইসব নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম। জীবনযাপন সম্পর্কে সচেতনতাও এদের তেমন নেই। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এরা বেশীরভাগ সময়ে সনাতন জ্ঞান, নিজস্ব ধারনা এবং আকাশের হাবভাব দেখে বুঝতে চেষ্টা করে। প্রায় ক্ষেত্রে এরা নিয়তির উপর নিজেদেরকে সমর্পন করে থাকে। তবে গত কয়েক বছরের বড় ধরনের ঝড় জলোচ্ছাস ও সাম্প্রতিক সিডরের কারনে এদের ভিতর কিছুটা সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এদের অধিকাংশের বাড়িতে রেডিও কিংবা টেলিভিশন নেই। তবে তারা স্থানীয় বিভিন্ন বাজারে রেডিও টেলিভিশন থেকে খবরাখবর পেয়ে থাকে।
গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে অনেক গুলো বড় বড় ঝড় জলোচ্ছাস গর্কী সহ বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে গিয়েছিলো। সে দুর্যোগ গুলোতে প্রচুর প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ‘৫৮.’৬০, ও ‘৭০ এর জলোচ্ছাস এ অঞ্চলে ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো। সে সময় এখানকার মানুষ কোনো মাধ্যম থেকে কেনো সংবাদই পেতোনা। সে সময়ের সরকার গুলোও ছিলো এব্যপারে একেবারেই উদাসীন।
নোয়াখালী সদরের সর্বদক্ষিনে হাতিয়া ষ্টিমার ঘাট ও অতিসম্প্রতি বয়ার চরের সর্বদক্ষিনে সমুদ্র উপকূলে ফেরী চলাচলের জন্য চেয়ারম্যান ঘাট নামক স্থানে বাংলাদেশ অভ্যন্তরিণ নৌপরিবহন সংস্থার একটি পল্টুন স্থাপিত হয়েছে । এখানে হাতিয়া দ্বীপ ও নোয়াখালীর মূল ভূখন্ডের মধ্যে ফেরি যোগাযোগ রয়েছে । এ এলাকায় মেঘনার মোহনায় প্রচুর সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলার ও ছোটছোট জেলে নৌকা এসে ভীড়ে থাকে । এই ফেরীঘাটের সুবাদে এখানে একটি জমজমাট বাজার গড়ে উঠেছে। এখানের অনেক জেলে জানিয়েছেন, তাদের অনেকেরই নিজস্ব কোনো রেডিও নেই। যারা চরের কাছাকাছি থেকে সাধারনত: মাছ ধরে থাকে। ছোট নৌকা নিয়ে তারা কখনো গভীর সমুদ্রে যায় না। কখনো কোনো দুর্যোগ দেখলে নদীর হাবভাব বুঝে সাবধানতা অবলম্বন করে। সারাদিন মাছ ধরা শেষে রাতে তারা চেয়ারম্যান ঘাটে কিংবা হাতিয়া ষ্টিমার ঘাটে আসলে লোকমুখে বিভিন্ন সংবাদ পেয়ে থাকে। নদীর কূলের এ বাজার গুলোতে এখন রেডিও তেমন শুনা হয়না। চা দোকান গুলোতে টেলিভিশন আছে । তাই সেখানে কাষ্টমারের ভীড় লেগে থাকে। যে দোকানে টেলিভিশন নেই সে দোকানে লোকজন তেমন যায় না। এসব দোকান গুলোতে বেশীর ভাগ সময় নাটক ও সিনেমা বেশী দেখা হয়। তবে দুর্যোগকালীন সময় সংবাদ বেশী দেখা হয়। এলাকার মানুষদের বদ্ধমূল ধারনা জন্মেছে যে, রেডিও টেলিভিশনে জাতীয় সংবাদ ছাড়া স্থানীয় সংবাদ প্রচারিত হয়না। তাই তারা খুব প্রয়োজনীয় তথ্য ও স্থানীয় সংবাদ গুলো লোকমারফত পেয়ে থাকে। তবে তা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয়না। দুর্গম অঞ্চলের অনেক মানুষ জানিয়েছেন গত সিডরের সময় তারা লোকমুখে সংবাদ পেয়েছিলেন। সাগরের অবস্থা দেখে তারা সাগর থেকে ডাঙ্গায় চলে এসেছেন, তবে অনেকে উপরে সাগরের কাছাকাছি নিজেদের ঘরেই ছিলেন। অনেকেই নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি।
জরিপের বিশ্লেষন: কমিউনিটি রেডিও’র অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু (content) সম্পর্কে অংশগ্রহণমূলক জরিপ কার্য চালানোর সময় জানা গেছে, এরকম একটি সম্প্রচার কেন্দ্র সন্মন্ধে অনেকেরই ধারনা খুবই অস্পস্ট। এব্যপারে অনেকের কোনো রকম কোনো ধারনাই নেই। তবে বিষয়টি বুঝার পরে সবার মধ্যেই প্রচুর আগ্রহের সৃষ্টি হয়। তারা সকলেই মত দেন যে এরকম একটি কেন্দ্র এলাকায় খুবই প্রয়োজন।
নোয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিনে সমুদ্র উপকূলের কয়েকটি এলাকায় মোট ২০জনের মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়। এখানে মাত্র দুজনের রেডিও এবং মাত্র এক জনের নিজস্ব একটি ছোট্ট টেলিভিশন ও রেডিও রয়েছে। তাদের অবশ্য খবর তেমন শুনা হয়না। রেডিওতে গান এবং টেলিভিশনে নাটক দেখা ও গানশুনা বেশী হয়। নারিদের শুধু নাটক ও গানই শোনা হয়। তবে পুরুষরা মাঝে মাঝে খবর শুনে থাকে। নারিদের মধ্যে খবর শুনার আগ্রহ খুব কম। গত সিডরের সময় পুরুষরা ১০০ শতাংশই রেডিও কিংবা টেলিভিশনে খবর পেয়েছেন কিন্তু ১০০ শতাংশ নারি বলেছেন তারা তাদের স্বামী কিংবা লোকমারফত খবর পেয়েছেন। ৮০শতাংশ বলেছেন তারা ঝড়ের পূর্বাভাষ পেয়ে নিজেদের জায়গায়ই অবস্থান করেন। এর কারণ হিসাবে তাঁরা বলেন বাড়ির নিরাপত্তা ও আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই। যেমন সেখানে কোথাও পানি বা বাথরুমের ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে বিশেষ করে মেয়েদের খুবই অসুবিধা পড়তে হয়। তাই অনেকেই সেখানে যেতে তেমন আগ্রহী হয়না। নিয়তির উপরও তারা অনেকাংশে নির্ভরশীল। ১০০ শতাংশ বলেছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়কালে তাঁরা আবহাওয়ার সংবাদ শুনতে চান। ১০০ শতাংশ বলেছেন তাদের অনুষ্ঠান দেখতে সবচেয়ে বেশী আগ্রহ নাটকের প্রতি । তবে বাংলা সিনেমার প্রতিও তাদের আগ্রহ রয়েছে।
১০০শতাংশ জানিয়েছেন, কমিউনিটি রেডিও স্থাপিত হলে শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশী অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। ৭০ শতাংশ জানিয়েছেন আনন্দের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দেয়া উচিত। অন্য ৩০ শতাংশ জানিয়েছেন শাসন না করলে শিশুদের পড়াশুনা হয়না। তবে তারা এও জানিয়েছেন এর মাত্রা যেন অতিরিক্ত না হয়। এ বিষয়ে শিশুদের উপযোগী অনুষ্ঠান প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথা তারা জানিয়েছেন। ১০০ শতাংশ জানিয়েছেন বয়ো:সন্ধিকালীন সময়ে মেয়েদের সমস্যা বিষয়ক সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান বিশেষ ভাবে প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। সবাই মনে করেন এ ব্যপারে মেয়েরা এমন কি অভিভাবকরাও এ বিষয়ে তেমন সচেতন নন। এ নিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক দ্বিধা কাজ করে। অনেকেই এ বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ করেন। এথেকে মেয়েরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিষয়ে ১০০শতাংশ জানিয়েছেন মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, সাধারন রোগবালাই, ডায়রিয়া, খাদ্যে পুষ্টিমান, টিকা প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতা মুলক অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। তবে মাত্র এক জন এইড্‌স বিষয়ে অনুষ্ঠান করার কথা জানিয়েছেন। বাসস্থান বিষয়ে ৭৫শতাংশ জানিয়েছেন, ভূমি ও ভূমির অধিকার বিষয়ে নানান অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। অবশ্য এ ব্যপারে পুরুষরাই বেশী আগ্রহী। নোয়াখালীতে তাঁত শিল্পের তেমন কোনো প্রসার নেই। এবিষয়ে কারো তেমন কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ১০০শতাংশই হস্তশিল্প ও নারিদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপে সম্পৃক্ততার বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করার কথা বলেছেন। একজন মন্তব্য করেন এক সময় নোয়াখালীতে প্রচুর তাঁতের প্রসার ছিলো । কিন্তু কালের গর্ভে তা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় স্থানে স্থানে যুগীপাড়া ছিলো। সেখানে লুঙ্গি গামছা শাড়ি এসব স্থানীয় ভাবে তৈরী হতো। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও এগুলো বাইরের জেলা গুলোতে চালান হতো। কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে পারলে সেগুলো হয়তো আবার চালু হবে। আশা করা যায় এ থেকে তখন হয়তো এ এলাকার অনেক উন্নতি সাধিত হবে।
১০০শতাংশ জানিয়েছেন কৃষিঋণ, সার, বীজ, উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ, হাঁস মুরগি পালন, কীটনাশক ছাড়া সব্জী চাষ, খাদ্যে পুষ্টিমান ইত্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করা প্রয়োজন।
১০০শতাংশ জানিয়েছেন অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যম হওয়া উচিত নাটক, কথিকা, জীবন্তিকা ইত্যাদির মাধ্যমে। এরা আরো জানিয়েছেন স্থানীয় ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে সবার কাছে তা গ্রহনযোগ্য হবে। এছাড়াও স্থানীয় ভাষায় নাটক, গান এবং স্থানীয় সমস্যা ও সমাধান ইত্যাদি বেশী বেশী প্রচার হওয়া দরকার বলে সবাই জানিয়েছেন।
উপসংহার:- সার্বিক জরিপে দেখা যায় এ এলাকার জন্য কমিউনিটি রেডিওর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুর্গম এ অঞ্চলের মানুষ কাছের খবরটিও সঠিক ভাবে পায়না। কথায় কথায এলাকাবাসী জানায়, ‘‍ইরােক েবামায় মানুষ মরার খবর আমরা সাথে সাথে রেডিও টেলিভিশনে পাই কিন্তু পাশের গ্রামে মড়ক লেগে হাঁসমুরগী মারা গেলে আমরা তার খবর পাইনা‍ অথচ এটি আমাদের জন্য অধিকতর জরুরী’। এখানে এটি স্থাপিত হলে শুধু দুর্যোগকালীন সময়েই নয়, এ কেন্দ্র গ্রামীণ জনগণের সার্বক্ষনিক দিনযাপনের অনুসঙ্গ হয়ে থাকেব। স্থানীয় ভাষায় স্থানীয় আঙ্গিকে স্থানীয় সমস্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে এটি জনগনের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং অধিক গ্রহনযোগ্যতা পাবে। এলাকায় সচেতনতা বাড়বে। উপকৃত হবে প্রান্তিক মানুষ।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক
মোবাইল: ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail: mhfoez@gmail.com

Mail to : massline@bangla.net
masslinemediacenter@yahoo.com



 
সকল সত্ব সংরক্ষিত সকল সত্ব সংরক্ষিত সকল সত্ব সংরক্ষিত This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free