|
|
|
নোয়াখালীর উপকূলীয় খাস জমির জটিলতা-২
খাসজমি নিয়ে ভূমিহীন এবং বন বিভাগের দ্বন্দ্ব চরমে
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
নোয়াখালীর উপকূলে বন বিভাগের কর্মচারীদের সাথে ভূমিহীনদের সংঘর্ষ এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ক’ বছরে চর লক্ষ্মী, বয়ারচর এবং নিঝুম দ্বীপে বড় ধরনের অসংখ্য সংঘর্ষের ঘটনা সকলের নজরে এসেছে। নোয়াখালীর উপকূল মূলত: মেঘনা ও সাগরের মোহনায় অবস্থিত। শত শত বছর ধরে এর উপকূল যেমন বার বার নদী ভাঙ্গনে ত-বিত হয়েছে; আবার জেগে উঠেছে নতুন নতুন ভূমি। নতুন ভূমি জেগে উঠলেই সেখানে বন বিভাগ বনায়ন শুরু করে। ভূমিহীনরাও তাদের সাধ্যমত যতটুকু তাদের আওতায় রাখা যায় ততটুকু জমি ঘের দখল করে চাষাবাদ করতে থাকে। শুরু হয় বিবাদ, দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ।
পটভূমি
নোয়াখালীতে ১৯৬৬ সন থেকে নতুন জেগে ওঠা চরে বনায়নের কাজ শুরু হয়। প্রথমে চর জব্বার ও হাতিয়াকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়। ১৯৭০ সনে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দূর্যোগে উপকূলে দশ লাখ মানুষ নিহত হলে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি অনুভূত হয়। স্বাধীনতার পরে ব্যাপক আকারে এর কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ১৯৭৬ সনে বন বিভাগের সঙ্গে সরকার এক চুক্তি স্বার করে। চুক্তিতে বলা হয় দশ বছর পর জমি পোক্ত হলে তা আবার সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেবে এবং তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক নং খাস খতিয়ানে চলে আসবে।
১৯৮৮ সনে আর এক ঘোষণায় তা দশ বছর থেকে বাড়িয়ে বিশ বছর করা হয়। কাজ শুরু করার সময় ভূমি মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বন বিভাগকে ৪ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর ভূমি হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। কাগজে কলমে এত বিপুল পরিমাণ জমি দেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ এই বিপুল জমির অধিকাংশই এখনো সাগর থেকে জেগে ওঠেনি।
স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বন বিভাগের দ্বন্দ্ব
স্থানীয় জনগণের সাথে বন বিভাগের দ্বন্দ্ব এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন বিভাগ এ অঞ্চলে কাজ শুরু করার আগে ভূমিহীনরা নিজেদের উদ্যোগে জমি লায়েক করে চাষাবাদ শুরু করে। পরে এ নিয়ে মারামারি, হিংসা, হানাহানি ও সংঘর্ষ হয়। সে জমির অনেকাংশ ভূমিহীনরা বন্দোবস্তও পেয়েছে। ভূমিহীনরা মনে করে যে এসব জমির অধিকার একমাত্র ভূমিহীনদেরই। কিন্তু বন বিভাগ এসে সে অধিকার ক্ষুন্ন করছে। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে বন বিভাগের ওপর ক্ষুব্ধ।
এ ব্যাপারে বন কর্মকর্তা শামছুল হক জানান, স্থানীয় মানুষের সাথে বন বিভাগের মূলত: কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত নেই বরং জনগণ বন বিভাগকে বনায়ন করতে আহবান জানায়। সমস্যা হয় তখন, যখন বন বিভাগ কোনো জমিকে বনায়ন করে দীর্ঘ পরিচর্যার পর সে জমি চাষাবাদ ও বসবাসের উপযোগী হয়। তখন প্রভাবশালীরা ভূমিহীনদের ব্যবহার করে সমস্যা তৈরি করে।
বন কর্মচারী ও ভূমিহীনদের সংঘর্ষ
২০০০ সনের ৩১ জানুয়ারি নোয়াখালী সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দেিণ চর লক্ষ্মী মৌজায় বন কর্মচারী ও ভূমিহীনদের এক সংঘর্ষে উভয় পরে নারী-পুরুষসহ প্রায় অর্ধশত আহত হয়। সংঘর্ষে বন বিভাগের ১০ জন কর্মী আহত হয়েছে। এ ঘটনায় এক ভূমিহীনের কন্যাকে অপহরণ করা হয়। ঘটনার পর পরস্পর বিরোধী দুটি মামলা এবং একটি নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের করা হয়।
ভূমিহীনরা অভিযোগ করে চর লক্ষ্মী মৌজার দণি পশ্চিম অংশের সরকারি খাস জমিতে তারা ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছিলো। ওই জমিটি সরকারি ১ নং খতিয়ানের অধীনে থাকায় তারা খাস জমি বন্দোবস্ত নীতিমালার আওতায় জমি বন্দোবস্ত নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো বলে জানায়। কিন্তু ওই বছর ৩১ জানুয়ারি সকাল সাড়ে দশটায় বন বিভাগের কতিপয় কর্মচারী ভাড়াটিয়া কিছু সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে অতর্কিতে ওই এলাকায় হামলা চালায়। তারা ভূমিহীন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে এলোপাথাড়ি লোহার রড, বন্দুকের বাট দিয়ে পিটাতে থাকে। এ সময় সেখানে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
ভূমিহীনরা আরো অভিযোগ করে এ সময় বন বিভাগের কর্মচারীরা ভূমিহীনদের বসতবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ও লুটপাট করে। এতে পাঁচটি বাড়ি পুড়ে ভস্মীভূত হয়। তাদের রার জন্য আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে বনরীরা তাদের ল করে বন্দুকের গুলি ছোড়ে। বন কর্মচারীরা ভূমিহীন আবদুল হাসিমের মেয়ে খোদেজা খাতুনকে অপহরণ করে বলে অভিযোগ করা হয়। এ বিষয়ে ডিউটি অফিসার আবদুর রহমানকে প্রধান আসামি করে নয় জনের বিরুদ্ধে খোদেজা নিজেই বাদী হয়ে নোয়াখালীর ১ম শ্রেণীর আদালতে একটি নারী নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করে।
অপরপে বন বিভাগ অভিযোগ করে চরলক্ষ্মী মৌজার ১৫০১ নং দাগে ১৯৭৫ সনে সৃজিত বনে কিছুসংখ্যক জবরদখলকারী জোরপূর্বক প্রবেশ করে বন বিভাগের মূল্যবান গাছ কেটে ফেলে। তারা অবৈধভাবে ঘর তুলে বেআইনিভাবে জমি জবর দখল করে। এতে বন বিভাগের কর্মচারীরা বাধা দিলে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে বন বিভাগের ১০ কর্মচারী মারাত্মক আহত হয়। এ ঘটনায় ফরেস্ট রেঞ্জার মোতাহের হোসেন বাদী হয়ে সিরাজুল মাওলা ওরফে দোলন মাঝির ছেলে হাছন রাজাকে প্রধান আসামি করে ১৯ জনের বিরুদ্ধে ১৪৩/৪৪/৩৫৫/৩৩২/৩০৭/৩৭৯/৪২৭ ধারায় সুধারাম থানায় একটি মামলা দায়ের করে।
সংঘর্ষে আহত বৃদ্ধা শাফিয়া খাতুন(৭৫) জানান, বন বিভাগের কর্মচারীরা তাদের বাড়ি-ঘর লুঠপাট ও আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘর বাঁচাতে গিয়ে সবাই (ভূমিহীনরা) আহত হয়।
বয়ারচরের বন ধ্বংসের নেপথ্যে
নোয়াখালীর দক্ষিণে সুধারাম ও লক্ষ্মীপুরের রামগতি সীমানা ধরে দক্ষিণ প্রান্তে সত্তরের দশক থেকে জেগে উঠেছে বিশাল চর, যা পরবর্তীতে বয়ার চর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বন বিভাগ এ চরে ব্যাপক বনায়ন করে। কিন্তু পরবর্তীতে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় এই বনাঞ্চল। এক সময় পুরো বন সন্ত্রাসীরা দখল করে নেয়, উচ্ছেদ হয়ে যায় বন বিভাগ। প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করে।
সহকারী বন সংরক্ষক শামছুল হক জানান, ‘পুরাতন নোয়াখালী’ একসময় সমুদ্রবক্ষে বিলীন হয়ে গেছে। বয়ারচর নামে কখনো কোনো ভূমি ছিলনা। সিকস্তি পয়স্তির আওতায়ও এ জমি পড়েনা। এটি কালক্রমে সমুদ্র থেকে জেগে ওঠে। ১৯৮৩-৮৪ সনে বন বিভাগ বনায়ন শুরু করে। ’৯৫-’৯৬ পর্যন্ত ১৫ হাজার ২৭ একর জমি বনায়ন করে। এর কিছু অংশ নোয়াখালী জেলার মধ্যে কিছু অংশ রয়েছে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে। দুই জেলায় পড়লেও মূলত এটি একই খন্ডের চরভূমি। বনায়ন করার ফলে যখন ধীরে ধীরে জমি লায়েক হয়ে ওঠে তখনই মানুষের লোভী চোখ পড়ে।
সর্বশেষ ২০০১ সনের ২৬ সেপ্টেম্বর বয়ার চরের ভাগ্য নির্ধারনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বয়ারচরকে সিডিএসপি’র (চর উন্নয়ন সংস্থা, সরকারি উন্নয়ন সংস্থা) কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য খাস ভূমি হিসাবে ঘোষণা দেয়া হলো। বয়ার চরকে তখন সিডিএসপি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। সহকারী বন সংরক শামছুল হক দাবী করেন, “নোয়াখালীর সমস্ত বন ধ্বংস করার পেছনে মূল দায়ী হলো এই সিডিএসপি। বলতে গেলে একশত ভাগ দায়ী এই সংস্থা।”
শামছুল হক জানান, বন বিভাগের সৃজিত বনে বন বিভাগ যেতে পারেনা অথচ সিডিএসপি পরিবার পরিজন নিয়ে সে বনের অভ্যন্তরে তাদের অবাধ বিচরণ। সন্ত্রাসীদের সাথে সম্পর্ক না থাকলে তা কোনোদিনও সম্ভব নয়। সিডিএসপির লোকেরা তাদের বন্ধু। পুলিশ তাদের বন্ধু হতে পারে না, ফরেস্টের লোকেরা তাদের বন্ধু হতে পারেনা, প্রশাসনের লোকেরা সন্ত্রাসীদের বন্ধু হতে পারে না।
শামসুল হকের ভাষ্যমতে সিডিএসপি-র ছত্রছায়ায় তথাকথিত ভূমিহীনদের এনে জমি দিয়ে ভূমিহীন নামে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া করছে। অথচ এ লোকগুলোকে সরকার জায়গা দেয়নি। চেয়ারম্যান মেম্বাররা পাঠায়নি। জেলা প্রশাসক, এসি-ল্যান্ড এমনকি কোনো তহশিলদার সার্টিফিকেট দেয়নি। কোনো এমপি সাহেবরা দেয়নি। এরা এসেছে গায়ের জোরে সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগ পুলিশ, বিডিআর দিয়েও তা রোধ করতে পারেননি। ২০০১ সনের ১০ ডিসেম্বর চর লাঙ্গলিয়াতে বন কর্মচারী আবুল কাসেম সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়। বয়ার চরের পূর্বপাশে এই চরটি বয়ার চরের মতই সাগর বক্ষ থেকে জেগে উঠেছে। সেখানেও সন্ত্রাসীরা বন ধ্বংস করে যাচ্ছে।
চর ওসমান থেকে নিঝুম দ্বীপ
নোয়াখালীর উপকূল নিত্য ভাঙা-গড়ার খেলায় মত্ত। শত শত বছর ধরে এই জনপদ যেমন নদী ও সাগর গর্ভে ভেঙ্গে বিলীন হয়েছে তেমনি আবার জেগে উঠছে নতুন নতুন চর ও দীপাঞ্চল। নিঝুম দ্বীপ তেমনি একটি জেগে ওঠা নতুন আকর্ষনীয় দ্বীপ। ষাটের দশকে এ দ্বীপটি সাগর ব থেকে জেগে উঠলে হাতিয়ার জেলেরা প্রথম এখানে বসবাস করতে শুরু করে। তখন এই দ্বীপটি ছিলো সামুদ্রিক বালুতে পরিপূর্ণ। সেই থেকে স্থানীয়রা এর নাম দেয় ‘বাল্লার চর’ বা ‘বালুর চর’। ওসমান নামে এক বাথানীয়া এখানে জেলেদের সংঘবদ্ধ করে। তার নামে এর নাম হয় ‘চর ওমসান’। সরকারি জরিপ ও দলিল দস্তাবেজে এর নাম লিপিবদ্ধ আছে ‘চর ওসমান’ হিসেবে। সাগর থেকে জেগে ওঠা আর দশটি দ্বীপের মতই ধীরে ধীরে জেগে উঠছিলো এটি। কিন্তু অন্য দ্বীপের চেয়ে এ দ্বীপটিতে আলাদা বৈশিষ্ট ধরা পড়ে। পরিবেশগত দিক থেকেও দ্বীপটি ভিন্ন প্রকৃতির।
বন বিভাগের অবৈধ আয়ের উৎস
স্থানীয় অধিবাসীরা জানায় বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা নিঝুম দ্বীপকে অর্থ উপার্জনের মোক্ষম স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই দ্বীপে তারাই একচ্ছত্র অধিপতি। বন রক্ষার নামে তারা নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচারের খড়গ চালিয়ে যাচ্ছে। নদীতে মাছ ধরার জন্য প্রতিটি খুঁটি প্রতিও দিতে হয় টাকা। টাকা ছাড়া কেউ নদীতে বিন্দি জাল বসাতে পারে না। ঘরের খুঁটির জন্য তারাই গাছ কেটে প্রতিটি পঞ্চাশ টাকা করে বখরা নিচ্ছে। বাগানে মহিষ চরাতে বাথানিয়াদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদার টাকা নেয়া হয়। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই মামলা। সমগ্র দ্বীপের মানুষদের মাঝে বিরাজ করছে মামলা আতঙ্ক। যখন তখন ধরে নিয়ে গিয়ে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করা হয় নিরীহ মানুষদের কাছে থেকে। বন-বিভাগের একজন সামান্য গার্ডও এখানে লাখ লাখ টাকা দাদন খাটায় বলে দ্বীপবাসী অনেকেই অভিযোগ করেছে।
বন বিভাগ-ভূমিহীন সংঘাত
নিঝুম দ্বীপের ভূমিহীন চাষী আকবর হোসেন (৪৫) ১৯৯৯ সনের ১৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বন পরিদর্শক ও প্রহরীদের গুলিতে নিহত হয়। আকবর নিহত হবার পর নিঝুম দ্বীপের ফরেস্ট বাংলো উত্তেজিত জনতা আক্রমন করে। নিঝুম দ্বীপের অধিবাসীরা অভিযোগ করেছে আকবর নিহত হবার নেপথ্যে রয়েছে বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও বন প্রহরীর বখরা না পাওয়াকে কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিহিংসা। এর শিকার হয়েই আকবরকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অপরদিকে বন কর্মকর্তারা জানায়, চুরি করে গাছ কাটার সময় বনরক্ষীরা বাধা দিলে সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আকবর গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এই ঘটনার পর বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্টাফরা অবস্থা বেগতিক দেখে নিঝুম দ্বীপে একজন পিয়নকে রেখে হাতিয়ায় চলে যায়।
মালেকের অভিযোগ: হত্যার বদলে চাকরি
আকবর নিহত হওয়ার পর তার পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তার পরিবারে ছিলো মা আয়শা খাতুন (৫৭) স্ত্রী হাফিজা খাতুন (৩৫) এবং সাতজন নাবালক সন্তান। আকবরের ভাই আবদুল মালেক অভিযোগ করে হত্যা মামলা নিস্পত্তির জন্য বনবিভাগ তাকে নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছে। অন্যদিকে আকবরের স্ত্রী সন্তানদের প্রলোভন দেখিয়ে জাহাজমারা রেঞ্জ অফিসে নিয়ে আসে। আবদুল মালেক আরো অভিযোগ করে, হত্যা মামলা ধামাচাপা দেয়ার জন্য আকবরের নাবালক ছেলেকে বোটম্যান হিসেবে চাকরি দেয়া হয়েছে। অপর পক্ষে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বন কর্মকর্তার বক্তব্য
আকবর হত্যার বিষয়ে সহকারী বন সংরক শামছুল হক জানান, সন্ত্রাসীদের অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফলে বয়ারচর ও নাঙ্গলীয়ার বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঠিক সেই ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলছিলো নিঝুম দ্বীপে। এই দ্বীপকে নিয়ে সরকারের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই এখানে একটি অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। এখানের সাত হাজার একর বনভূমির ভেতর কয়েক হাজার হরিণ আছে। যে কোনো মানুষ এখন নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বনের হরিণ দেখতে পারে। সন্ত্রাসীরা যে ভাবে উল্লম্ফন শুরু করেছিলো সেখানে হরিণতো দূরের কথা একটি গাছও থাকতো না। এটি বাধা দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের বাধার সম্মুখীন হয়। আকবরের ভাই মালেক হলো সবচেয়ে সন্ত্রাসী নেতা। আকবর ছিলো তার অনুচর। এরা বার বার বন ধ্বংস করতে গেলে বনরক্ষীরা বাধা দেয়, এক পর্যায়ে তারা বন কর্মচারীদের ওপর আক্রমন করলে বনরক্ষীরা আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুঁড়ে। এতে আকবরের পায়ে গুলি লাগে। তাকে বাঁচানোর জন্য বনকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো। নিজেরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রাস্তাঘাটহীন দুর্গম এলাকা থেকে হাসপাতালে নিতে নিতে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
সংসদ সদস্যের বক্তব্য
হাতিয়ার সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, এসব ভূমিহীনদের কি করে পুনর্বাসন করা যায় তার জন্য সামাজিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে। অন্যদিকে বন বিভাগের কর্মীদেরঅকান্ত শ্রমে গড়া নিঝুমদ্বীপের বনসম্পদ রক্ষার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও গ্রহণ করা দরকার।
বন বিভাগের প্রস্তাবনা
নোয়াখালীর উপকূলে সমুদ্রবক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত জেগে উঠছে নতুন নতুন চর, নতুন জনপদ। এই জেগে ওঠার ফলে জেলার আয়তনও বেড়ে যাচ্ছে। এই নতুন চরকে বাসপোযোগী করে গড়ে তোলার জন্য সরকার বন বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে। বন বিভাগ সুনির্দিষ্টভাবে কিছু সুপারিশমালা পেশ করেছে। বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্প একটি যুগান্তকারী সফল প্রকল্প। এতে জনগণ বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। এই সফলতার প্রেক্ষিতে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়ার সময় বনায়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এতে এককভাবে একটি পরিবারকে এক একর জমি বন্দোবস্ত দেয়া হবে। সেই জমির দশ শতাংশ থাকবে বসতভিটা সহ পুকুর ইত্যাদি। পঁয়ত্রিশ শতাংশ থাকবে বনভূমি। বাকি পঞ্চাশ শতাংশ থাকবে কৃষি জমি। পারিবারিক বনায়নের সম্পূর্ণই করা হবে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে। বন বিভাগ সমস্ত খরচে বন সৃজন করে দেবে। এটি হবে সামাজিক বনায়নের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। এ ছাড়াও যৌথ বনায়নের আওতায় যৌথ বন্দোবস্তেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এ নীতিতে বন্দোবস্তপ্রাপ্ত ভূমিহীন কৃষকরা ব্যাপক উপকৃত হবে বলে বন বিভাগ জানায়। কৃষকের একই জায়গায় বন, বসতি, কৃষি চাষ নিয়ে পরিবারটি গড়ে উঠবে একটি গ্রামীন খামার হিসেবে। এতে পরিবেশেরও ব্যাপক উন্নতি হবে। প্রকৃত ভূমিহীন কৃষকদের জমি পাওয়ারও নিশ্চয়তা থাকবে।
প্রশাসনের লোকেরা সন্ত্রাসীদের বন্ধু হতে পারে না।
শামসুল হকের ভাষ্যমতে সিডিএসপি-র ছত্রছায়ায় তথাকথিত ভূমিহীনদের এনে জমি দিয়ে ভূমিহীন নামে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া করছে। অথচ এ লোকগুলোকে সরকার জায়গা দেয়নি। চেয়ারম্যান মেম্বাররা পাঠায়নি। জেলা প্রশাসক, এসি-ল্যান্ড এমনকি কোনো তহশিলদার সার্টিফিকেট দেয়নি। কোনো এমপি সাহেবরা দেয়নি। এরা এসেছে গায়ের জোরে সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগ পুলিশ, বিডিআর দিয়েও তা রোধ করতে পারেননি। ২০০১ সনের ১০ ডিসেম্বর চর লাঙ্গলিয়াতে বন কর্মচারী আবুল কাসেম সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়। বয়ার চরের পূর্বপাশে এই চরটি বয়ার চরের মতই সাগর ব থেকে জেগে উঠেছে। সেখানেও সন্ত্রাসীরা বন ধ্বংস করে যাচ্ছে।
চর ওসমান থেকে নিঝুম দ্বীপ
নোয়াখালীর উপকূল নিত্য ভাঙা-গড়ার খেলায় মত্ত। শত শত বছর ধরে এই জনপদ যেমন নদী ও সাগর গর্ভে ভেঙ্গে বিলীন হয়েছে তেমনি আবার জেগে উঠছে নতুন নতুন চর ও দীপাঞ্চল। নিঝুম দ্বীপ তেমনি একটি জেগে ওঠা নতুন আকর্ষনীয় দ্বীপ। ষাটের দশকে এ দ্বীপটি সাগর বক্ষ থেকে জেগে উঠলে হাতিয়ার জেলেরা প্রথম এখানে বসবাস করতে শুরু করে। তখন এই দ্বীপটি ছিলো সামুদ্রিক বালুতে পরিপূর্ণ। সেই থেকে স্থানীয়রা এর নাম দেয় ‘বাল্লার চর’ বা ‘বালুর চর’। ওসমান নামে এক বাথানীয়া এখানে জেলেদের সংঘবদ্ধ করে। তার নামে এর নাম হয় ‘চর ওমসান’। সরকারি জরিপ ও দলিল দস্তাবেজে এর নাম লিপিবদ্ধ আছে ‘চর ওসমান’ হিসেবে। সাগর থেকে জেগে ওঠা আর দশটি দ্বীপের মতই ধীরে ধীরে জেগে উঠছিলো এটি। কিন্তু অন্য দ্বীপের চেয়ে এ দ্বীপটিতে আলাদা বৈশিষ্ট ধরা পড়ে। পরিবেশগত দিক থেকেও দ্বীপটি ভিন্ন প্রকৃতির।
বন বিভাগের অবৈধ আয়ের উৎস
স্থানীয় অধিবাসীরা জানায় বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা নিঝুম দ্বীপকে অর্থ উপার্জনের মোক্ষম স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই দ্বীপে তারাই একচ্ছত্র অধিপতি। বন রক্ষার নামে তারা নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচারের খড়গ চালিয়ে যাচ্ছে। নদীতে মাছ ধরার জন্য প্রতিটি খুঁটি প্রতিও দিতে হয় টাকা। টাকা ছাড়া কেউ নদীতে বিন্দি জাল বসাতে পারে না। ঘরের খুঁটির জন্য তারাই গাছ কেটে প্রতিটি পঞ্চাশ টাকা করে বখরা নিচ্ছে। বাগানে মহিষ চরাতে বাথানিয়াদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদার টাকা নেয়া হয়। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই মামলা। সমগ্র দ্বীপের মানুষদের মাঝে বিরাজ করছে মামলা আতঙ্ক। যখন তখন ধরে নিয়ে গিয়ে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করা হয় নিরীহ মানুষদের কাছে থেকে। বন-বিভাগের একজন সামান্য গার্ডও এখানে লাখ লাখ টাকা দাদন খাটায় বলে দ্বীপবাসী অনেকেই অভিযোগ করেছে।
বন বিভাগ-ভূমিহীন সংঘাত
নিঝুম দ্বীপের ভূমিহীন চাষী আকবর হোসেন (৪৫) ১৯৯৯ সনের ১৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বন পরিদর্শক ও প্রহরীদের গুলিতে নিহত হয়। আকবর নিহত হবার পর নিঝুম দ্বীপের ফরেস্ট বাংলো উত্তেজিত জনতা আক্রমন করে। নিঝুম দ্বীপের অধিবাসীরা অভিযোগ করেছে আকবর নিহত হবার নেপথ্যে রয়েছে বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও বন প্রহরীর বখরা না পাওয়াকে কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিহিংসা। এর শিকার হয়েই আকবরকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অপরদিকে বন কর্মকর্তারা জানায়, চুরি করে গাছ কাটার সময় বনরীরা বাধা দিলে সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আকবর গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এই ঘটনার পর বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্টাফরা অবস্থা বেগতিক দেখে নিঝুম দ্বীপে একজন পিয়নকে রেখে হাতিয়ায় চলে যায়।
মালেকের অভিযোগ: হত্যার বদলে চাকরি
আকবর নিহত হওয়ার পর তার পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তার পরিবারে ছিলো মা আয়শা খাতুন (৫৭) স্ত্রী হাফিজা খাতুন (৩৫) এবং সাতজন নাবালক সন্তান। আকবরের ভাই আবদুল মালেক অভিযোগ করে হত্যা মামলা নিস্পত্তির জন্য বনবিভাগ তাকে নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছে। অন্যদিকে আকবরের স্ত্রী সন্তানদের প্রলোভন দেখিয়ে জাহাজমারা রেঞ্জ অফিসে নিয়ে আসে। আবদুল মালেক আরো অভিযোগ করে, হত্যা মামলা ধামাচাপা দেয়ার জন্য আকবরের নাবালক ছেলেকে বোটম্যান হিসেবে চাকরি দেয়া হয়েছে। অপর পক্ষে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বন কর্মকর্তার বক্তব্য
আকবর হত্যার বিষয়ে সহকারী বন সংরক্ষক শামছুল হক জানান, সন্ত্রাসীদের অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফলে বয়ারচর ও নাঙ্গলীয়ার বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঠিক সেই ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলছিলো নিঝুম দ্বীপে। এই দ্বীপকে নিয়ে সরকারের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই এখানে একটি অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। এখানের সাত হাজার একর বনভূমির ভেতর কয়েক হাজার হরিণ আছে। যে কোনো মানুষ এখন নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বনের হরিণ দেখতে পারে। সন্ত্রাসীরা যে ভাবে উল্লম্ফন শুরু করেছিলো সেখানে হরিণতো দূরের কথা একটি গাছও থাকতো না। এটি বাধা দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের বাধার সম্মুখীন হয়। আকবরের ভাই মালেক হলো সবচেয়ে সন্ত্রাসী নেতা। আকবর ছিলো তার অনুচর। এরা বার বার বন ধ্বংস করতে গেলে বনরক্ষীরা বাধা দেয়, এক পর্যায়ে তারা বন কর্মচারীদের ওপর আক্রমন করলে বনরীরা আত্মরার্থে গুলি ছুড়ে। এতে আকবরের পায়ে গুলি লাগে। তাকে বাঁচানোর জন্য বনকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো। নিজেরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রাস্তাঘাটহীন দুর্গম এলাকা থেকে হাসপাতালে নিতে নিতে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
সংসদ সদস্যের বক্তব্য
হাতিয়ার সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, এসব ভূমিহীনদের কি করে পুনর্বাসন করা যায় তার জন্য সামাজিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে। অন্যদিকে বন বিভাগের কর্মীদের অকান্ত শ্রমে গড়া নিঝুমদ্বীপের বনসম্পদ রার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও গ্রহণ করা দরকার।
বন বিভাগের প্রস্তাবনা
]
|
|
|
|
|
|
|
ভালোবাসার একটি গোলাপ
সাতরাজারই ধন,
কোথায় খুঁজিস ওরে ক্ষেপা
এইতো আপন জন।
|
|
নীরবে কেটেছে দিবস আমার
নীরবে কেটেছে রাত,
নীরবে হেনেছে হৃদয় আমার
প্রণয়ের অভিসম্পাত।
|
|
রঙ দেখেছো রঙ ?
শাওন রাতের
নিকষ কালো
অন্ধকারের রঙ !
রঙ দেখেছো রঙ ! |
|
কমিউনিটি রেডিও’র অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু (content)
সম্পর্কে অংশগ্রহণমূলক জরিপ
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী একটি দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। নোয়াখালী সদরের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই চর এলাকা। এখানে বাস করে সাধারন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অধিকাংশই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। তাছাড়াও দিনমজুর, রিক্সাশ্রমিক, জেলে প্রভৃতি পেশার মানুষ এখানে বাস করে। খুব কমসংখ্যক নারি কৃষি সহ বিভিন্ন কাজ করলেও তারা মূলত ঘরকন্যার কাজ করে থাকে। ঘর কেন্দ্রিক নানান কাজের সঙ্গেও এরা জড়িত। এইসব নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম। জীবনযাপন সম্পর্কে সচেতনতাও এদের তেমন নেই। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এরা বেশীরভাগ সময়ে সনাতন জ্ঞান, নিজস্ব ধারনা এবং আকাশের হাবভাব দেখে বুঝতে চেষ্টা করে। প্রায় ক্ষেত্রে এরা নিয়তির উপর নিজেদেরকে সমর্পন করে থাকে। তবে গত কয়েক বছরের বড় ধরনের ঝড় জলোচ্ছাস ও সাম্প্রতিক সিডরের কারনে এদের ভিতর কিছুটা সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এদের অধিকাংশের বাড়িতে রেডিও কিংবা টেলিভিশন নেই। তবে তারা স্থানীয় বিভিন্ন বাজারে রেডিও টেলিভিশন থেকে খবরাখবর পেয়ে থাকে।
গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে অনেক গুলো বড় বড় ঝড় জলোচ্ছাস গর্কী সহ বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে গিয়েছিলো। সে দুর্যোগ গুলোতে প্রচুর প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ‘৫৮.’৬০, ও ‘৭০ এর জলোচ্ছাস এ অঞ্চলে ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো। সে সময় এখানকার মানুষ কোনো মাধ্যম থেকে কেনো সংবাদই পেতোনা। সে সময়ের সরকার গুলোও ছিলো এব্যপারে একেবারেই উদাসীন।
নোয়াখালী সদরের সর্বদক্ষিনে হাতিয়া ষ্টিমার ঘাট ও অতিসম্প্রতি বয়ার চরের সর্বদক্ষিনে সমুদ্র উপকূলে ফেরী চলাচলের জন্য চেয়ারম্যান ঘাট নামক স্থানে বাংলাদেশ অভ্যন্তরিণ নৌপরিবহন সংস্থার একটি পল্টুন স্থাপিত হয়েছে । এখানে হাতিয়া দ্বীপ ও নোয়াখালীর মূল ভূখন্ডের মধ্যে ফেরি যোগাযোগ রয়েছে । এ এলাকায় মেঘনার মোহনায় প্রচুর সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলার ও ছোটছোট জেলে নৌকা এসে ভীড়ে থাকে । এই ফেরীঘাটের সুবাদে এখানে একটি জমজমাট বাজার গড়ে উঠেছে। এখানের অনেক জেলে জানিয়েছেন, তাদের অনেকেরই নিজস্ব কোনো রেডিও নেই। যারা চরের কাছাকাছি থেকে সাধারনত: মাছ ধরে থাকে। ছোট নৌকা নিয়ে তারা কখনো গভীর সমুদ্রে যায় না। কখনো কোনো দুর্যোগ দেখলে নদীর হাবভাব বুঝে সাবধানতা অবলম্বন করে। সারাদিন মাছ ধরা শেষে রাতে তারা চেয়ারম্যান ঘাটে কিংবা হাতিয়া ষ্টিমার ঘাটে আসলে লোকমুখে বিভিন্ন সংবাদ পেয়ে থাকে। নদীর কূলের এ বাজার গুলোতে এখন রেডিও তেমন শুনা হয়না। চা দোকান গুলোতে টেলিভিশন আছে । তাই সেখানে কাষ্টমারের ভীড় লেগে থাকে। যে দোকানে টেলিভিশন নেই সে দোকানে লোকজন তেমন যায় না। এসব দোকান গুলোতে বেশীর ভাগ সময় নাটক ও সিনেমা বেশী দেখা হয়। তবে দুর্যোগকালীন সময় সংবাদ বেশী দেখা হয়। এলাকার মানুষদের বদ্ধমূল ধারনা জন্মেছে যে, রেডিও টেলিভিশনে জাতীয় সংবাদ ছাড়া স্থানীয় সংবাদ প্রচারিত হয়না। তাই তারা খুব প্রয়োজনীয় তথ্য ও স্থানীয় সংবাদ গুলো লোকমারফত পেয়ে থাকে। তবে তা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয়না। দুর্গম অঞ্চলের অনেক মানুষ জানিয়েছেন গত সিডরের সময় তারা লোকমুখে সংবাদ পেয়েছিলেন। সাগরের অবস্থা দেখে তারা সাগর থেকে ডাঙ্গায় চলে এসেছেন, তবে অনেকে উপরে সাগরের কাছাকাছি নিজেদের ঘরেই ছিলেন। অনেকেই নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি।
জরিপের বিশ্লেষন: কমিউনিটি রেডিও’র অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু (content) সম্পর্কে অংশগ্রহণমূলক জরিপ কার্য চালানোর সময় জানা গেছে, এরকম একটি সম্প্রচার কেন্দ্র সন্মন্ধে অনেকেরই ধারনা খুবই অস্পস্ট। এব্যপারে অনেকের কোনো রকম কোনো ধারনাই নেই। তবে বিষয়টি বুঝার পরে সবার মধ্যেই প্রচুর আগ্রহের সৃষ্টি হয়। তারা সকলেই মত দেন যে এরকম একটি কেন্দ্র এলাকায় খুবই প্রয়োজন।
নোয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিনে সমুদ্র উপকূলের কয়েকটি এলাকায় মোট ২০জনের মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়। এখানে মাত্র দুজনের রেডিও এবং মাত্র এক জনের নিজস্ব একটি ছোট্ট টেলিভিশন ও রেডিও রয়েছে। তাদের অবশ্য খবর তেমন শুনা হয়না। রেডিওতে গান এবং টেলিভিশনে নাটক দেখা ও গানশুনা বেশী হয়। নারিদের শুধু নাটক ও গানই শোনা হয়। তবে পুরুষরা মাঝে মাঝে খবর শুনে থাকে। নারিদের মধ্যে খবর শুনার আগ্রহ খুব কম। গত সিডরের সময় পুরুষরা ১০০ শতাংশই রেডিও কিংবা টেলিভিশনে খবর পেয়েছেন কিন্তু ১০০ শতাংশ নারি বলেছেন তারা তাদের স্বামী কিংবা লোকমারফত খবর পেয়েছেন। ৮০শতাংশ বলেছেন তারা ঝড়ের পূর্বাভাষ পেয়ে নিজেদের জায়গায়ই অবস্থান করেন। এর কারণ হিসাবে তাঁরা বলেন বাড়ির নিরাপত্তা ও আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই। যেমন সেখানে কোথাও পানি বা বাথরুমের ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে বিশেষ করে মেয়েদের খুবই অসুবিধা পড়তে হয়। তাই অনেকেই সেখানে যেতে তেমন আগ্রহী হয়না। নিয়তির উপরও তারা অনেকাংশে নির্ভরশীল। ১০০ শতাংশ বলেছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়কালে তাঁরা আবহাওয়ার সংবাদ শুনতে চান। ১০০ শতাংশ বলেছেন তাদের অনুষ্ঠান দেখতে সবচেয়ে বেশী আগ্রহ নাটকের প্রতি । তবে বাংলা সিনেমার প্রতিও তাদের আগ্রহ রয়েছে।
১০০শতাংশ জানিয়েছেন, কমিউনিটি রেডিও স্থাপিত হলে শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশী অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। ৭০ শতাংশ জানিয়েছেন আনন্দের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দেয়া উচিত। অন্য ৩০ শতাংশ জানিয়েছেন শাসন না করলে শিশুদের পড়াশুনা হয়না। তবে তারা এও জানিয়েছেন এর মাত্রা যেন অতিরিক্ত না হয়। এ বিষয়ে শিশুদের উপযোগী অনুষ্ঠান প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথা তারা জানিয়েছেন। ১০০ শতাংশ জানিয়েছেন বয়ো:সন্ধিকালীন সময়ে মেয়েদের সমস্যা বিষয়ক সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান বিশেষ ভাবে প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। সবাই মনে করেন এ ব্যপারে মেয়েরা এমন কি অভিভাবকরাও এ বিষয়ে তেমন সচেতন নন। এ নিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক দ্বিধা কাজ করে। অনেকেই এ বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ করেন। এথেকে মেয়েরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিষয়ে ১০০শতাংশ জানিয়েছেন মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, সাধারন রোগবালাই, ডায়রিয়া, খাদ্যে পুষ্টিমান, টিকা প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতা মুলক অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। তবে মাত্র এক জন এইড্স বিষয়ে অনুষ্ঠান করার কথা জানিয়েছেন। বাসস্থান বিষয়ে ৭৫শতাংশ জানিয়েছেন, ভূমি ও ভূমির অধিকার বিষয়ে নানান অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। অবশ্য এ ব্যপারে পুরুষরাই বেশী আগ্রহী। নোয়াখালীতে তাঁত শিল্পের তেমন কোনো প্রসার নেই। এবিষয়ে কারো তেমন কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ১০০শতাংশই হস্তশিল্প ও নারিদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপে সম্পৃক্ততার বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করার কথা বলেছেন। একজন মন্তব্য করেন এক সময় নোয়াখালীতে প্রচুর তাঁতের প্রসার ছিলো । কিন্তু কালের গর্ভে তা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় স্থানে স্থানে যুগীপাড়া ছিলো। সেখানে লুঙ্গি গামছা শাড়ি এসব স্থানীয় ভাবে তৈরী হতো। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও এগুলো বাইরের জেলা গুলোতে চালান হতো। কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে পারলে সেগুলো হয়তো আবার চালু হবে। আশা করা যায় এ থেকে তখন হয়তো এ এলাকার অনেক উন্নতি সাধিত হবে।
১০০শতাংশ জানিয়েছেন কৃষিঋণ, সার, বীজ, উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ, হাঁস মুরগি পালন, কীটনাশক ছাড়া সব্জী চাষ, খাদ্যে পুষ্টিমান ইত্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করা প্রয়োজন।
১০০শতাংশ জানিয়েছেন অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যম হওয়া উচিত নাটক, কথিকা, জীবন্তিকা ইত্যাদির মাধ্যমে। এরা আরো জানিয়েছেন স্থানীয় ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে সবার কাছে তা গ্রহনযোগ্য হবে। এছাড়াও স্থানীয় ভাষায় নাটক, গান এবং স্থানীয় সমস্যা ও সমাধান ইত্যাদি বেশী বেশী প্রচার হওয়া দরকার বলে সবাই জানিয়েছেন।
উপসংহার:- সার্বিক জরিপে দেখা যায় এ এলাকার জন্য কমিউনিটি রেডিওর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুর্গম এ অঞ্চলের মানুষ কাছের খবরটিও সঠিক ভাবে পায়না। কথায় কথায এলাকাবাসী জানায়, ‘ইরােক েবামায় মানুষ মরার খবর আমরা সাথে সাথে রেডিও টেলিভিশনে পাই কিন্তু পাশের গ্রামে মড়ক লেগে হাঁসমুরগী মারা গেলে আমরা তার খবর পাইনা অথচ এটি আমাদের জন্য অধিকতর জরুরী’। এখানে এটি স্থাপিত হলে শুধু দুর্যোগকালীন সময়েই নয়, এ কেন্দ্র গ্রামীণ জনগণের সার্বক্ষনিক দিনযাপনের অনুসঙ্গ হয়ে থাকেব। স্থানীয় ভাষায় স্থানীয় আঙ্গিকে স্থানীয় সমস্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে এটি জনগনের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং অধিক গ্রহনযোগ্যতা পাবে। এলাকায় সচেতনতা বাড়বে। উপকৃত হবে প্রান্তিক মানুষ।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক
মোবাইল: ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail: mhfoez@gmail.com
Mail to : massline@bangla.net
masslinemediacenter@yahoo.com
|
|
|
|
|
|
|
|